বিশ্ব নারী দিবস ২০১৫
আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইমেন: পাঠ প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব নারী দিবস ২০১৫ সামনে রেখে প্রকাশিত হয়েছে বিশাল কলেবরের এক গ্রন্থ আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইমেন।বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসের মত ডাকসাইটে বিজ্ঞানী এ গ্রন্থে বলেছেন,“পৃথিবীর প্রায় সব রহস্যই বিজ্ঞানের মাধ্যমেই উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে আমার পক্ষে। কিন্তু নারীর রহস্য জানা অসম্ভব মনে হয়।” এই জীবন্ত কিংবদন্তী বিজ্ঞানী যদি এমন হাল ছেড়ে দেয়া মন্তব্য করেন তখন এ গ্রন্থ পাঠের আগ্রহ কমে আসে। তবুও এগোই; পাঠ প্রতিক্রিয়াতো শেষ করতে হবে।
এই গ্রন্থে কবি জীবনানন্দ দাশের সুরঞ্জনাকে নিয়ে বিপত্তির কথা লেখা হয়েছে। একটা আলা ভোলা লোক সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় সুরঞ্জনা অন্য কোন যুবকের সঙ্গে খোশ গল্পে চলে গেল কী-না।বড় কষ্টকর এই অভিজ্ঞতা। এই ঝামেলা চিরকুমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান মিয়ার ছিল না। তাই গুছিয়ে শিক্ষকতা, রাজনীতি করেছেন। এই তুলনা-প্রতিতুলনার মাঝ দিয়ে এগিয়েছে চিন্তার অন্তঃসলিল প্রবাহ।
বলে রাখা জরুরী, এই গ্রন্থের লেখক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। ফলে গ্রন্থের প্রচ্ছদে কোন লেখকের নাম নেই। লেখকের কাছে এই প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, “নারীদের ক্ষেপানো মোল্লাদের ক্ষেপানোর চেয়ে অধিক ভয়ংকর। মোল্লা আক্রমণ করলে অমোল্লা দেশে গিয়ে থাকা সম্ভব; কিন্তু অ-নারীদেশ তো এ গ্রহে নেই।”
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, উনি নারী প্রসঙ্গে বলেছেন, “অনেক কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি, তোমার কথা বোঝার আশা দিয়াছি জলাঞ্জলি।”
বেগম রোকেয়া বলেছেন, “সুলতানার স্বপ্ন রাজ্য প্রতিষ্ঠাই আমার শপথ।” বেগম রোকেয়ার মতো ঘোমটা পরে বাংলাদেশ শাসন তো চলছেই। এই গ্রন্থে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্যকে দৃষ্টান্তমূলক বলা হয়েছে। অর্থনীতি শাস্ত্রে তাদের ব্যুতপত্তি খুব সম্ভবতঃ এই সাফল্যগাথা রচনা করতে সাহায্য করেছে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার’র নারী ভাবনা এ গ্রন্থে লেডী ম্যাকবেথের চরিত্র ও তিন ডাকিনীর প্রতীকের মাঝ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আধুনিক নারীরা বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন। এটি লেডী ম্যাকবেথ সিনড্রোম এমনটাই বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লেখক।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নারী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, “প্রেসিডেন্সি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নো কমেন্টস” বলেছেন। তবে; রিটায়ারমেন্টের পর তিনি নিজেই একটি নারী বিরোধী গ্রন্থ লেখার অঙ্গীকার করেছেন। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন উনার “নারীভাগ্য ভালো। ফলে লুজারদের দলে তিনি নন।”
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, “প্রতিদিন ব্রেক ফাস্ট টেবিলে লরার বকা-ঝকাই তাকে ইরাক অভিযানে মানসিকভাবে প্রণোদিত করেছে।” টেক্সাসের কাউ বয় ভঙ্গীতে তিনি বলেন, “আমাকে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিলো ওসামা বিন লাদেন।”
রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিনকে গ্রন্থের লেখক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে জর্জরিত করেন। পুতিন জার্মান গোয়েন্দাদের কারণে বেশ সচেতন ছিলেন মন্তব্য প্রকাশে। উনি যা বলেছেন তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, “কট্টর খ্রীস্টিয় পন্থী আঙ্গেলা ম্যারকেল আমার নারী বিষয়ক স্ক্যান্ডালগুলোর যেরকম খোঁজ খবর করছেন, মনে হচ্ছে না ইউরোপে কখনো রেনেসাঁ এসেছিলো। এইগুলো এশীয় সামষ্টিক উকুন তোলা নারী-সমাজের কাজ। ইউরোপে এসব কী! এই কী নারী স্বাধীনতা বা ক্ষমতায়ন।ম্যারকেল নিজের চরকায় তেল দিলেই পারেন।”
কবি টিএস এলিয়টের ব্যর্থ প্রেমিক প্রুফকের কাব্য এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। আলোচনা হয়েছে নিও এলিট ফাঁপা নারীদের নিয়ে, স্পা-সমাজকে নিয়ে; যারা আর্ট গ্যালারীতে গিয়ে কিছুই না জেনে মিকেল এঞ্জেলোকে নিয়ে কথা বলে। সমসাময়িক বাস্তবতায় টকশো’তে রাজনৈতিক আলোচনায়ও তাদের দেখা মেলে। তোতলা নারী উপস্থাপিকা ‘আইকন’ হয়ে ওঠে।
লেখক খুশওয়ান্ত সিং-কে খুব সাবধানতার সঙ্গে এ গ্রন্থে ঠাই দেয়া হয়েছে। উনি বলেছেন, “মুম্বাইয়ে একটা পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে যে নারী সহকর্মী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা ওটা রেঁধে আনতেন, উনি আমার ফেয়ার ওয়েলে আসেননি। কারণ আমি তখন আর সম্পাদক নই।
পুরুষবাদী সমাজ জোর করে হেলেন অফ ট্রয়ের মত মাঙ্গলিক চরিত্র সৃষ্টি করেছে কীনা; এর অনুসন্ধানে কবি আবুল হাসান বলছেন,
“তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এচোখ
মাথার খুলির নীচে নরম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?”
ইবসেনের ডলস হাউজের নোরা চরিত্রটি কোথায় গিয়েছিলো, সেই অনুসন্ধানে জানা যায়, নোরা একটি নারী বিষয়ক এনজিও খুলে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ীতে চড়েছেন। কিন্তু সেই অনুপাতে সুইডেনের নারী সমাজের কোন উন্নতি হয়নি। নোবেল পুরস্কারের জন্য লবি করেও ম্যানেজ করতে পারেননি। ঘরের কাছে বসে সাফল্যের রূপকথা বানিয়ে এ পুরস্কার পাওয়া কঠিন। এগুলো অজানা দেশে বসে করা যায়।
শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে জিজ্ঞেস করা হয় মোনালিসা প্রসঙ্গে। উনি বলেন সরল মনের কোন মডেল না পেয়ে নিজের মুখটাই বসিয়ে দিয়েছি।” ইদানীং দেখি কেউ কেউ মুখের ওপর হিজাব চড়িয়ে দিয়েছে। কেউ পরিয়ে দিয়েছে বিকিনী। ঠিক পরিমিত মোনালিসা বুঝি নেই।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট নারীবিজ্ঞানী (!) মোল্লা তেঁতুলকে নারী প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, কেন তার ১৩ দফা! উনি বলেছেন, ১৩ দফা ছাড়া ৪ জন বিবি কন্ট্রোল করা অসম্ভব। টেলিফোনে শুনছো না, সাঈদী তার বিবির কাছে কেমন ধমক খায়! আমারো একি পরিস্থিতি। তাই দরবেশের হেলিকপ্টারে ঘুরি।আল্লাহ তায়ালা এই ম্যাজিক কার্পেট আমাকে দিয়াছেন। আর এখন ১৩ দফা দিয়া কী হইবো, দ্যাশ চলতেছে মদিনা সনদে। ৫শত মসজিদ হইতেছে; আম্মা হুজুরেরা পর্দা করিতেছে।বাকশালের সহিত ভিন্নমত ছিলো, কিন্তু পাকশালের সঙ্গে সহমত হইয়াছে। জমিজমা পাইয়াছি;পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই; আমিতো ভাই ঘরের মালিক নই।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সকে জিজ্ঞেস করা হয়, নাস্তিকতাতো লিবেরলিজম। বিজ্ঞান দিয়ে যা খুশী প্রমাণ করুন। কিন্তু প্রফেট মুহাম্মদের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে টানাটানি কেনো! এটা কী উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। গ্যোয়েটের সাহিত্য দর্শন আলোচনায় তার ক’জন গার্লফ্রেন্ড ছিল এ প্রশ্ন গ্রাম্য ও অপ্রাসঙ্গিক-অরেনেসীয়। ডকিন্স বলেন, দেখুন আমাদের পক্ষে একজনের বেশী গার্লফ্রেন্ড মেইনটেন করা সম্ভব নয়; আমরা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী; আর ফেমাস হয়ে গেলে পাপারাজ্জিরাও পিছু নেয়। তাই এ ব্যাপারে একটু ঈর্ষাতো কাজ করেই। কিন্তু এর জন্য মোল্লারা এসে আমাকে খুন করতে পারেনা।
ডকিন্স এক বিপদের গল্প করেন। আফ্রিকার একটি গোত্রের সঙ্গে থেকে গবেষণাকালে ঐ গোত্রে একটু সাদা শিশু জন্ম নেয়। শিশুর পিতা আমাকে সন্দেহ করে। আমি জেনেটিকসে এরকম সম্ভাবনার কথা বলি; শ্যামল পিতা মাতার শুভ্রসন্তান হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান মানতে চায় না সেই ক্ষুব্ধ পিতা। আমি তখন একটি ভেড়ার পাল দেখিয়ে বলি, দেখুন এই দলে সবগুলো ভেড়া সাদা কিন্তু একটি কালো ভেড়াও রয়েছে। ক্ষুব্ধ লোকটি দপ করে নিভে যায়। সে অনুরোধ করে, আপনি এই কালো ভেড়ার ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না; আমিও আর আমার শিশুর গাত্রবর্ণ নিয়ে কথা তুলব না।এই লোকের বিজ্ঞান শিক্ষা জরুরী।
নারীবাদী লেখক ভার্জিনিয়া উলফকে জিজ্ঞেস করা হয়, উনি কী নারীর ক্ষমতায়নে খুশী। উনি মিসেস ড্যালওয়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “সে পসেসিভ বয়ফ্রেন্ডকেও পছন্দ করেননি; নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী উদার স্বামী নিয়েও সুখী হননি।” তাই এই চিরন্তন দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে খুব সম্ভব।
এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংউইমেন গ্রন্থটি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থ। এক জীবনে এটা পড়ে শেষ করা কঠিন। বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ে যা বুঝলাম পৃথিবীর অসম্ভবতম কাজে হাত দিয়েছেন এই লেখক। সম্ভবতঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীদের সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন তা উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থের অনুসিদ্ধান্ত পর্যায়ে।
‘দেবদাসের’ ট্র্যাজেডী সমাজের সবস্তরের পুরুষের জীবনকেই চিত্রিত করেছে। তা সে ভিনসেন্ট ভ্যান গঁগা-ই হোক বা বান্দরবানে স্ত্রীর ভয়ে গাছে চড়ে বসে থাকা শ্রমজীবী পুরুষই হোক। ভারতে এখন নতুন আইন হচ্ছে, “ডেসপারেট হাউজ ওয়াইভস`দের মাসে মাসে বেতন দিতে হবে।” ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ পুরুষ মাসের পুরো উপার্জন স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়; আলাদা করে বেতন দেবার কী আছে বোঝা কঠিন। আর পশ্চিমে হালকা পা ফসকে একটা ডিভোর্স হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাচ্ছে পুরুষ সমাজ।
ঔপন্যাসিক কোয়েটজি তাই মুক্তি খুঁজেছেন ‘বিবাহ’ প্রতিষ্ঠানের বাইরে। তার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যকর্মের প্রধান উপজীব্য দক্ষিণ আফ্রিকার একজন অধ্যাপকের জীবন ভাবনা। যে কোন মায়ায় জড়ায় না। এক গোছা রজনীগন্ধ্যা আর কিছু ডলার উপহার দিয়ে খুঁজে নেয় মুক্তির মন্দির সোপানতল। কোয়েটজি হয়তো বলতে চান, আর নয় বৃথা বলিদান।
পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখক কেবল একজন পেশাদার শিল্প-সমালোচক; তার কাছে নারীবাদী গ্রন্থ এনে দিলেও সে হাজারখানেক শব্দের রিভিউ লিখে দেবে নৈর্ব্যক্তিকভাবে। কাজেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লেখকের `আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইমেন` গ্রন্থের রিভিউ নিয়ে গ্রন্থ সমালোচকের সঙ্গে মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রত্যাশিত নয়।
কবি হেলাল হাফিজের ‘প্রস্থান’ কবিতার কটি চরণ দিয়েই আমি আপাততঃ এই আলোচনা থেকে প্রস্থান করি।
“এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷”
( লেখাটি লেখকের ৮ মার্চ ২০১৫’র ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া।)
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএইচকে
নিউজবাংলাদেশ.কম