নারী দিবসের ডায়েরি
এই হালকা শীতের সকালে রোদটা গায়ে মাখতে মাখতে খুব একটা রোমান্টিক কবিতা ভাবছিলাম। আসলে প্রেম নিজে এতো উষ্ণ একটি বোধ— আর শীতকাল তো উষ্ণতার জন্য তৃষিত থাকেই। তাই কোন প্রেমের কবিতায় উষ্ণতার ছড়াছড়ি থাকবে— এটাই স্বাভাবিক। যদিও আমার পিতা মনে করেন মেয়েদের একটু রেখে ঢেকে কথা বলা উচিৎ, প্রকৃতি নিয়ে লেখা উচিৎ, শব্দের লাগাম টেনে লেখা উচিৎ... ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পিতা হিসেবে তিনি ঠিকই বলেছেন। একজন অতি আধুনিক, অসভ্য, বেয়াদব সন্তান হিসেবে তার কথা মেনে আমি চলতে চাইলেও আমার কলম চলে না। আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রও কি তিনি একই পরামর্শ দিতেন!!! তাহলে?! আসলে আমাদের এই বৈষম্যের সংস্কৃতি কিন্তু থামছেনা। আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছিনা বৈষম্য আসলে কোথায় করছি? আমার আধুনিক মননের পিতা সম্পত্তি বিভাজনের ক্ষেত্রে আমার এবং ভাইয়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন, কিন্তু এটাই কি শেষ কথা? আমি নারীবাদী নই, কিন্তু আমার মতে সমঅধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু বিভ্রান্তি তৈরী হচ্ছে। বৈষয়িক হবার কারনে অধিকার হয়ে উঠেছে মোটা দাগে সম্পত্তি বিভাজনের হিসাব। কিন্তু, এই বস্তুদুনিয়ার ভেতরে থেকেও, অধিকার শব্দটিই তো নিজের বোধ হারিয়ে ফেলছে। এতে অধিকার আদায়ের পরিবর্তে অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আজকের বিশ্ববাজারে নারী পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি যেমন নারীবাদী নই, তেমনি পুরুষবাদীও নই। একটি সাধারন স্থান থেকে বিবেচনা করে কথাগুলো লিখছি। বাজারে রব উঠল, নারী কর্মক্ষেত্র জয় করছে। ভগ্নী, জায়া, পত্নী —সবাই চলল কর্মক্ষেত্রে, চাকুরি হল তাদের, যারা আড়ি মারতে পটু এবং দেখতে ভাল! এখানে সমঅধিকারের চেয়ে পণ্য হিসেবেই তো নারীকে বেশী দেখা যাচ্ছে! বিশ্ব মিডিয়াতে এখন যে নারীর শরীরে পোশাক কম, নায়িকা হিসেবে তার মূল্য বেশী! অথচ, অভিনয়, চরিত্র— ইত্যাদির প্রাধান্য থাকে পুরুষের ক্ষেত্রে। এর স্পর্শের ভয়াবহতা এতো বেশী যে, আমাদের মেয়েদের শরীর থেকেও অবলীলায় শাড়ী খুলে নিয়ে নিজের বাজারী সংস্কৃতিকে পড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর আমরাও আধুনিকতার নামে, উন্নতির নামে পোশাকী উন্নয়নে জড়িয়ে নিচ্ছি আমাদের। অনেকসময় মনে হয় নারীরা নিজেরাই তাদের অবস্থান নিচে নামিয়ে আনছে। যে মেয়েটি যোগ্যতা নিয়ে এগুচ্ছে, সে পিছিয়ে পরছে আরেক নারীর আড়ি মারার ক্ষমতা থেকে উদ্দেশ্যমূলক চর্চার কাছে! তাহলে একতরফা পুরুষের দোষ দিয়ে কি লাভ? কিছু নারীর এ ধরনের ব্যবহারের কারনে আসলে মানুষ নারীর ক্ষমতার উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলছে— নারী নিজে যদি বুঝতে না পারে যে অধিকার মানে সম্ভ্রমের সাথে সহমত ও মনন নিয়ে বাঁচার অধিকার— নিজেকে পণ্য করে তোলা নয়, তবে তাকে কে বোঝাবে? অনেক কথা বললাম। নারী হয়ে নারীকে শক্র বলার দরুন অনেকে নাক সিঁটকাবে—আমার কিছু যায় আসে না। যদি কিছু মেয়ে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়,তবেই চলবে। প্রেমিকের মুখে শোনা একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। নিউমার্কেট এলাকায় এক মেয়েকে এক যুবক ইচ্ছাকৃত ধাক্কা দিল। মেয়েটি তাকে থামাতেই সে মেয়েটিকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল। মেয়েটি একটু ঘাবড়ে পরক্ষণেই ছেলেটিকে উল্টো গালি শুরু করল। বরাবর দর্শক হয়ে থাকা সাধারন মানুষের কেউই মুখ খোলেনি, সকলের মানসিক বিচারে ছেলেটিই দোষী। মুখ খুললেন একজন নারী। তিনি বলতে লাগলেন, "একটা মেয়ে কিভাবে এত গালাগালি করে?" অথচ কথা ছিল,একজন নারী হিসেবে তিনি মেয়েটির পাশে দাঁড়াবেন। আমার প্রেমিক সেদিন হতাশ হয়ে বলেছিল,"ক্যামনে বদলাবি, তোরা নিজেরাই তো নিজেদের শত্রু!" না,আমি তার মত এতো হতাশ নই। মানসিকতার বিচারে আমার পিতা আর প্রেমিকের মাঝে যেমন অনেক ব্যবধান, তেমনি সব নারীও একরকম নয়। আমার প্রত্যাশা, প্রতিটি নারী অধিকার এবং আত্মসম্মান সম্পর্কে সঠিকভাবে জানুক এবং আত্মবিশ্বাসে ভর করে সামনে এগিয়ে যাক— নারীর কর্মদক্ষতার উপর সমাজ বিশ্বাস ফিরে পাক।
নিউজবাংলাদেশ.কম