News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ১ অক্টোবর ২০২০
আপডেট: ১৭:৪১, ১ অক্টোবর ২০২০

ছবির পিঠে স্মৃতিচারণ

ছবির পিঠে স্মৃতিচারণ

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নৌবন্দর শহর চাঁদপুরে। আমার জীবনে তাই সদরঘাটের বিস্তৃত স্মৃতি আছে। নদীপথে আমার প্রথম যাত্রাকে অবশ্য ভ্রমণ বলা চলে না। তখন আমার বয়স খুবই কম। কোলের শিশু। এমন সময়েই ঠাণ্ডাজনিত কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। চাঁদপুরের ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিলে কোন এক গভীর রাতে মিতালী নামের এক লঞ্চে চেপে আব্বা ও আম্মা আমাকে নিয়ে যান শেরেবাংলা নগরের শিশু হাসপাতালে। বাসা থেকে তৈরি হতে দেরি হওয়ায় আমার জন্য নাকি চাঁদপুরের নৌ পুলিশকে দিয়ে ছাড়ার সময় পেরিয়ে যাবার পরও মিতালীকে ঘাটে আটকে রাখা হয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য।

সেই থেকে শুরু। প্রথমে বেঙ্গল ওয়াটার, পরে ঈগল, আর এখন তো বেশুমার নৌযান। কতো শতবার যে এসবে চেপে এই সদরঘাট হয়ে রাজধানীর বুকে পা রেখেছি, তা ইয়ত্তারহিত।

আমার ছোটবেলায় সদরঘাট মোটেও এমন ছিলোনা। লঞ্চে বসে রূপলাল হাউসের কাছ থেকেই দেখা যেতো আহসান মঞ্জিলের কমলা গুম্বজ। স্কুলে থাকতেও বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর আগে বর্তমানের পানগাঁও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালের কাছ থেকে গেণ্ডারিয়ার মিলব্যারাকের একটি চারতলা দালান স্পষ্ট দেখা যেতো। লঞ্চের বারান্দা থেকে আব্বা এটা আমাকে দেখাতেন আর এর ইতিহাস বলতেন। 

আমি বড়ই অবাক হয়ে শুনতাম যে, এই বিল্ডিং নাকি ১৮৫৭ সালে সংঘটিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবহ। এই ভবনে নাকি শুরুতে একটি কারখানা ছিলো। এজন্যই এর নাম মিলব্যারাক। পরে ১৮৫৭ সালে সিপাহী রজব আলীর নেতৃত্বে লালবাগ কেল্লায় অবস্থিত দেশীয় সিপাহীরা শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সার্বভৌম ঘোষণা করে অস্ত্রধারণ করলে মিলব্যারাক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুগত সৈন্যদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। মিলব্যারাক এখন পুলিশের অধীন। তবে ওই চারতলা দালানটি এখনো আছে কিনা, জানিনা।

হয়তো নদীতে ভ্রমণের সময়ই কখনো প্রথমবার জেনেছিলাম নাব্যতা সংকটের কারণে একটা দীর্ঘ সময় বুড়িগঙ্গায় স্টীমার চলাচল ছিলো বন্ধ। সম্ভবত গোটা পাকিস্তান আমলে সদরঘাটে বড় জাহাজ, তথা রকেট চলাচল করতে পারতো না। ছোটছোট লঞ্চ বা ট্রলার চলতো। ঢাকায় যেতে হলে চাঁদপুরের যাত্রীরা নারায়ণগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত যেতেন। 

অবশ্য বুড়িগঙ্গায় জাহাজ চলাচল বন্ধের পেছনে আব্বার কাছে অন্য গপ্পোও শুনেছি। সেটা হচ্ছে, ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাব খাজা আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহ গুরুতর রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হাফিজুল্লাহর বয়স ছিলো অনেক কম। কিন্তু তিনি ছিলেন অসুস্থ। 

১৮৮৪ সালে শিশুকালেই তিনি মারা যান। তার স্মরণে ঢাকার নবাবকে খুশি করতে ঢাকার ইংরেজ অভিজাতরা আহসানুল্লাহর মৃত শিশুপুত্রের সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেয়। বাহাদুর শাহ পার্কের দক্ষিণ পাশে, তথা বাংলাবাজারের দিকটায় এই স্মৃতিস্তম্ভ আজো ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে।

শোনা যায়, একদিন সদরঘাট বা বাদামতলী ঘাটের কাছে ভিড়ার সময় একটি জাহাজের ভেঁপুর আওয়াজে সদ্য ঘুমানো খাজা হাফিজুল্লাহর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ নবাব ঢাকায় স্টীমারের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

তখন জাহাজের ভেঁপু প্রলম্বিত লয়ে বেজে যেতো কয়েক মিনিট ধরে, যা সত্যিই শ্রবণকারীদের জন্য বিড়ম্বনার জন্ম দিতো। আর এই ভেঁপুর আওয়াজ শোনাও যেতো বহু মাইল ব্যাপী এলাকা জুড়ে। অথচ বহু মাইলের কথা বাদ দেই, এখন যদি চাঁদপুরের কোন এসএসসির ছাত্রকেও আমি বলি, ছোট বেলায় রকেট বা ঈগলের গুরুগম্ভীর ভেঁপু কিংবা অন্যন্য লঞ্চের 'কোঁয়াও কোঁয়াও' শব্দে ছাড়া সাইরেনের আওয়াজ শহরের ষোলঘর এলাকা থেকেও স্পষ্ট শোনা যেতো, তাহলে সে হয়তো আমাকে অবিশ্বাসই করবে। 

অথচ কেবল ভেঁপুর শব্দই নয়, এই ধরুন রাত এগারোটার পর থেকে কান পাতলে আমাদের বাসা থেকেই আকাশপথে মোটামুটি এক কিলোমিটার দূরে থাকা মেঘনা নদীতে চলাচলকারী নৌযানের ইঞ্জিনের ভটভট আওয়াজও শোনা যেতো মৃদুমন্দ লয়ে!

যাহোক, মোটামুটি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বুড়িগঙ্গায় নাব্যতা সংকট ছিলো। সেই বছর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়। জাসদ গণবাহিনীর নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের ছিলেন তখন ড্রেজার অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান। তাঁর সময়েই ড্রেজার অর্গানাইজেশন বহু দশকের এক অসাধ্য সাধন করে।

তবে এরপরও ইতিহাসে সঙ্গত কারণেই ড্রেজার অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্নেল তাহেরের কোন অবস্থান নেই। তিনি অবশ্য বেশিদিন এখানে থাকেনও নি। অচিরেই এই চাকরী ছেড়ে দিয়ে আউট ল জীবনে চলে যান। তারপরের ইতিহাস এখানে অপ্রাসঙ্গিক...।

সাঁঝেরবাতিতে আলোকিত বাকল্যান্ডস রো আর ঢাকা নদীবন্দরের এই ছবিটি তুলেছেন নাকিব শাহ আলম। উপরের লেখা বা স্মৃতিচারণা আসলে গৌণ। এতো সুন্দর একটি ছবি শেয়ারের উছিলা মাত্র।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়