‘অন্তর্যাত্রা’ কিংবা স্মৃতিহীন জীবনের মানেহীনতা
পিয়াস মজিদ
২০০৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। ‘বলাকা’ হলে আমার প্রথম দেখা সিনেমা তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। সিনেমাটি দেখে রাতেই আমার দর্শন-প্রতিক্রিয়া লিখে রাখি ডায়েরিতে আর একটু ঘষে-মেজে সেটা সেবছরই ছাপা হয় একটা লিটলম্যাগে। কী করে যেন আমার সেই অকিঞ্চিৎকর আলোচনা পৌঁছে যায় স্বয়ং তারেক মাসুদের কাছে। এক ঘর্মাক্ত দুপুরে ইতিহাসের ততোধিক বিরক্তিকর-ঘর্মাক্ত ক্লাস করছি, এই ফাঁকে একটা কল দেখা গেল আমার ফোনে। ধরতেই বললেন, ‘পিয়াস, আমি তারেক মাসুদ বলছি। আপনার আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।’ আমি তো তাজ্জব একেবারে। আমার লেখায় ‘মাটির ময়না’র সংলাপসহ দু’একটা বিষয়ে হালকা নেতিবাচক মন্তব্য ছিল, তারেক ভাই সেজন্যে ক্ষিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমাকে গ্রহণ করলেন অসাধারণ আন্তরিকতায়। মাঝেমধ্যেই ফোনে আলাপ হতো, কিছুদিন বাদে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের মুভি ‘অন্তর্যাত্রা’ ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে প্রদর্শিত হবে বলে শুনলাম। তারেক মাসুদ আমার ও আমার বন্ধুদের জন্য পাঁচটা সৌজন্য টিকেটের কথা বলে রাখলেন গেটে। আমি হুটহাট কাউকে না পেয়ে থিয়েটারকর্মী প্রিয় দোলা’পু (সামিউন জাহান দোলা, যিনি এখন ‘নভেরা’ নাটকের অনন্য একক মঞ্চাভিনেত্রী)-কে নিয়ে দেখতে গেলাম।
দেখলাম। বুঁদ হয়ে রইলাম। প্রদর্শনী-শেষে তারেক মাসুদের বক্তব্য শুনলাম। কিন্তু হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার তাগাদা ছিল বলে তারেক ভাইয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ও আলাপ হল না।
পরসকালে ফোন। তারেক ভাই। আমি গতবিকেলে দেখেছি কিনা ‘অন্তর্যাত্রা’! আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রদর্শনীতে ছিলাম শুনে রীতিমতো রাগান্বিত হয়ে বললেন ‘আপনি একবার দেখা করে গেলেন না!’
আমি তারেক ভাইয়ের ভালোবাসায় আপ্লুত। কিছুদিন বাদে ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেলাম। ফোন এল তারেক ভাইয়ের। বললেন “পিয়াস, ‘মাটির ময়না’ নিয়ে আপনার অনুভূতি যেভাবে লিখেছেন, সেভাবেই লিখুন না ‘অন্তর্যাত্রা’ নিয়ে।”
আমি বিস্মিত। আমার মতো এলেবেলে লেখকের কাছে তারেক মাসুদের অনুরোধ। লিখব বলে ডায়েরিতে নোট রেখেছিলাম। লেখা হলো না। তারেক ভাই আর অনুরোধ করেননি বরং ‘কানসাটের মানুষেরা’ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পাবলিক লাইব্রেরিতে। আমার স্বভাব-সংকোচে এবারও মুখোমুখি দেখা ও কথা হলো না।
এরপর যোগাযোগহীন অনেকদিন। একদিন খবর এল।
‘কাগজের ফুল’ বানাতে মানিকগঞ্জে তারেক মাসুদ। ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা।
কাগজের ফুলে রক্তের ছোপ।
তারেক ভাইয়ের সাথে আর দেখা হলো না। কিন্তু আজ বহুবছর পর অনুজ জায়েদের অনুরোধে ‘অন্তর্যাত্রা’ নিয়ে লিখতে বসে আমার অক্ষম কলম যেন তারেক ভাইয়ের অনুরোধটি রক্ষা করছে।
তারেক ভাই, একটু পড়ে দেখবেন....
২.
‘অন্তর্যাত্রা’ স্মৃতি ও সত্তার যুগলগাথা। প্রত্যক্ষত অভিবাসী জীবনের গল্প, পরোক্ষত অন্তর্গত নির্বাসনের কবিতা।
নির্বাসন-প্রিয়জন, প্রিয় স্মৃতি এবং প্রিয় নিজের থেকে
মুভিটা যার মৃত্যু ঘিরে আবর্তিত সেই রফিকের অবয়ব অনুপস্থিত দর্শকের সমুখে তবু রফিক সব চরিত্রকে চালিত করে; জীবনের বিভক্তি যেভাবে মৃত্যুতে এসে মানুষকে একত্র করার অবকাশ পায়।
প্রাক্তন স্বামী রফিকের মৃত্যুর খবরে বিলাতবাসী শিরিন আর তার ছেলে সোহেল বাংলাদেশে ফেরে। শিরিনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রফিক বিয়ে করে সালমাকে, তাদের ঘরেও আছে রিনি নামে এক কিশোরীকন্যা।
শিরিন হয়তো নিয়মরক্ষার জন্যই দেশে আসে কিন্তু এই আগমন তার এতকালের নিয়ম করে বন্ধ রাখা স্মৃতির দুয়ার হাট করে খুলে দেয় পুত্র সোহেলের কাছে।
শিরিনের ঢাকার বাড়িতে একমাত্র ভাই খালেদ। খালেদ অবিবর্তিত থাকলেও ইতিমধ্যে বদলে গেছে সময়, সমাজ, দেশ।
দেশভাগের স্মৃতি হয়ে তাদের বাড়িতে আছে তুলসিবেদি আর পুরনো কেয়ারটেকার লক্ষ্মণ দাশ। ‘মুন’ সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে কিন্তু টিমটিম করে এখনও আছে ‘স্টার’ সিনেমাহল। শিরিনের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ ‘চাঁদ চলে গেছে। তারা তবু আছে।’
হ্যাঁ, অবশিষ্ট তারার আলোয় সোহেল তার না-দেখা, না-জানা বাবা ও ভূতপূর্বকে দেখার সুযোগ পায়।
রফিকের কুলখানিতে মা-ছেলে সিলেটে চলে।
ট্রেনের জানালায় শিরিন আর সোহেলের নির্বাক অথচ অন্তর্মুখর অবয়ব যেন মুভিটার কেন্দ্রদৃশ্য। সার্বভৌম সবুজের বুক চিরে ট্রেনের সর্পিল গতিময়তা যেন মা-ছেলের মনের দূরত্ব-বাড়া, জঙ্গম আবহই ফুটিয়ে তোলে।
সোহেলের দাদা, ফুপু নাজমা, তার স্বামী ইকবাল, রফিকের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সালমা আর তার মেয়ে রিনি যখন শমসেরনগরের চা-বাগান লাগোয়া বাংলোবাড়িতে রফিকের মিলাদ ও স্মরণে এক হয় তখন তাদের নিজেদের বিভক্তিগুলোও স্পষ্ট হয়।
শিরিনের বিস্ময়, এত সুন্দর প্রকৃতি ছেড়ে মানুষ ঢাকার জঞ্জালে কী করে! নাজমার ততোধিক বাস্তবিক উত্তর,
‘এক দু’দিন ঠিক আছে। কিন্তু বছরের পর বছর এই নিখিল নৈঃশব্দ্যের ভেতরে বসবাস মানুষের বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়।’
দাদা সোহেলকে নিয়ে প্রথমে রফিকের কবরে, তারপর ব্রিটিশদের সিমেট্রিতে যায়। পড়ন্ত বেলার আলোছায়া সমান খেলা করে স্বদেশি ও বিদেশি মৃতদের অন্তিম ঠিকানার গায়ে। সোহেল দেখে, একটা সাত মাস বয়সী শিশুর কবর, আবার বহু বছর আয়ু পাওয়া মানুষেরও কবর। ভাগ্যান্বেষণে এদেশে এসেছিল তারা কিন্তু নিজের দেশে চিরঘুমের ভাগ্য পায়নি। দাদা তার নাতিকে বলে, চাবাগানে বিয়ের গীত ধামাইল-গাওয়া শ্রমিকদের কথা, যারাও নিজ মাটি থেকে আজ বহুদূরে। উড়িষ্যার মানুষ, বিহারের মানুষ এখন বাংলায়; তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে আছে অথচ কল্পনায় লালন করে চলেছে ভিন্ন এক দেশ। ঠিক যেমনটি, সোহেলের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। মা তাকে বলেনি তার বাবার কথা, দাদার কথা, দেশের কথা কিন্তু আজ জন্মের এতবছর পর বাংলাদেশ, বাবা ও স্বজনেরা তার কাছে লন্ডনের বন্ধুদের কাছে দেখানো নেহায়েত একটা ভিউকার্ডের থেকে অনেক বৃহত, অনেক গহন-গভীর ও সবুজ হয়ে দেখা দিচ্ছে আর মায়ের প্রতি রাগ তার ততই বাড়ছে।
সোহলের মতো শিরিনও নতুন করে জানতে শুরু করে রফিককে। যে প্রগতিশীল রফিককে সে ব্যবহারিক জীবনে মনে করেছিল রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক, সে রফিককে আজ তার দ্বিতীয় স্ত্রী সালমার বয়ানে সে আবিষ্কার করে একজন ভুল-বোঝা, প্রেমী-মানুষরূপে, বিচ্ছেদ হলেও যার ভেতর সবসময় জপ হতো শিরিনের নাম। চলে গিয়ে এভাবে কাছে আসে রফিক আর সব এলোমেলো হয়ে যায় শিরিনের।
সিলেট থেকে অতঃপর ফেরার সময় হয় সোহেল ও শিরিনের। আবার সেই ট্রেনের জানালা; যে কিনা এই মুভির বিশিষ্ট এক চরিত্র। মা নিজেকে মেলে ধরে ছেলের কাছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে সন্তানের জন্ম, সেই সোহেলকে হারানোর ভয়ে এতকাল সে অর্গল দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু রুদ্ধ কপাট তাকেই করেছে বেশি বঞ্চিত। নিজে আর বিয়ে করেনি, অসীম একাকীত্বকে বরণ করেছে ছেলের জন্য। সোহেলকে সবসময় যেন পাহারা দিয়ে রেখেছে, জানতে দেয়নি তার পিতা ও পটভূমি; পাছে সে মায়ের কাছ থেকে চলে যায় দূরে।
আজ রফিকের মৃত্যুর পর অনুভব করে এভাবে সে শুধু সোহেলকেই নয়, নিজেকেও করেছে বঞ্চিত ভীষণ। স্বার্থপর ভালোবাসার পরিণাম তো ভয়াবহ। একতরফা প্রতিশোধের আগুন একসময় খাক করে দেয় নিজেরই ভেতরবাড়ির দালানকোঠা।
শিরিন ঘুমিয়ে পড়ে। ট্রেনের বাইরে ফেব্রুয়ারি মাসের আবছা কুয়াশা। আলো-আঁধারির মায়ামূর্ছনায় সোহেল একবার মায়ের ঘুমন্ত মুখ আর একবার ফ্রেমে বাঁধা বাবার ছবির পানে তাকায়। ভাবে, ভাবতেই থাকে-জীবন কি ফেলে আসে সময় ও জমির খণ্ড? সেখানে জন্ম নেয়া স্মৃতির ফসল এতই উর্বরা যে, বেঁচে থাকতে দূরে থাকা বাবা আজ মরে গিয়ে শুধু তার না, মায়েরও কাছে এসে বসেছে। মানুষ যতই পালাক তার স্মৃতি থেকে, ততই সে সেখানে ফিরে ফিরে আসে অন্তহীন যাত্রাতে। ট্রেনটা থেমে গেলেও এই যাত্রা শেষ হওয়ার না। দূর চাবাগান থেকে ভেসে আসা কীর্তনের সুরে যেন এই বাণীই ধরা আছে, ‘স্মৃতিহীন জীবনের কি মানে আছে কোনো...’
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ