News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৬:৩২, ২৫ এপ্রিল ২০২০
আপডেট: ০৪:২৬, ১৬ মে ২০২০

বাংলাদেশের চন্দ্র দর্শন কড়চা-২

দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি

বাংলাদেশের চন্দ্র দর্শন কড়চা-২

২০০১ সালে প্রথম হাসিনা ওয়াজেদ মন্ত্রীসভার মেয়াদ শেষ হবার কিছু আগে এক রায়ে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা দেশে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো ফুঁসে ওঠে। এদেশে আগে ডানপন্থী রাজনীতি সীমিত ছিলো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের দল মুসলিম লীগ কিংবা নিজস্ব প্রশিক্ষিত ক্যাডার ভিত্তিক জামায়েতে ইসলামীর মতো দলগুলোয়। বিচ্ছিন্নভাবে মাদ্রাসার হুজুররাও রাজনীতি করতেন। তবে এখনকার মতো কেবল মাদ্রাসা অধ্যুষিত এতো রাজনৈতিক দল তখন ছিলোনা।

জেনারেল এরশাদের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে মাদ্রাসা ভিত্তিক রাজনীতি জোরদার হতে শুরু করে। এই রাজনীতির মশাল হাতে মাঠে নামেন প্রায় শতবর্ষজীবী লালবাগের বড় হুজুর মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি হাফেজ্জী হুজুর নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় হয়ে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। হাফেজ্জী হুজুর ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও অংশ নেন।

বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর কিছু এলাকাভিত্তিক রাজবংশ আছে। লালবাগ মাদ্রাসা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইউনুসিয়া মাদ্রাসা ঘিরে এমন দুটি রাজবংশের ন্যায় প্রভাবশালী গ্রুপ ছিলো (এখনো আছে)। আগের যুগে রাজবংশগুলো যেমন রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জন্য নিজেদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ জারী রাখতো, ঠিক তেমনিভাবে লালবাগ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুই রাজবংশের মধ্যে বিয়ে হয়ে হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুফতি ফজলুল হক আমিনী হাফেজ্জী হুজুরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হন।

২০০১ সালে ফতোয়া বিরোধী রায়ের সূত্রে মুফতি আমিনী বেশ মাঠ গরম করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে মাদ্রাসা ছাত্র মারা যাবার ঘটনাও ঘটে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট ভূমিধ্বস জয় অর্জন করে। মুফতি আমিনী জোটের অংশ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসন থেকে জয়ী হন।

নির্বাচনের আগ থেকেই মুফতি আমিনী ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু বেগম জিয়া প্রায় ৬০ সদস্যের যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন, তাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন বাস্তব কারণে কোন ধর্মগুরুকে তিনি স্থান দেননি। এই নিয়ে ধর্মভিত্তিক শরীকদের সাথে তাঁর টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। এই টানাপোড়নের কারণে পাঁচ বছরে পাঁচ বছরে এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর রদবদল করতে হয়।

প্রথমে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যশোরের নাজিম উদ্দীন আল আজাদকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ করেন। ৯ মাস পর তাকে সরিয়ে দিয়ে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়ে কুমিল্লার কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। ১১ মাস পর তাঁকে সরিয়ে পটুয়াখালীর কেরামত আলীকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। এরপরের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী গাজীপুরের আবদুল মান্নান ছিলেন প্রায় ১৭ মাস। এরপর ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ভোলার মোশারেফ হোসেন শাহজাহান। তিনি জোট সরকারের অবশিষ্ট সময় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ে এতো রদবদলের পেছনে দায় ছিলো এই মন্ত্রণালয়ের বাগডোর নিয়ে ধর্মভিত্তিক শরীকদের সাথে বিএনপির টানাহেঁচড়া। তবে বিএনপি শেষ পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি।

মূলত তখন থেকেই হুজুররা চাঁদ দেখা কমিটি বা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গ্রহণযোগ্যতা কমাতে নানা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। নানা মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। একবার তো মুফতি আমিনী চাঁদ দেখা নিয়ে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। তিনি এক কিশোর মাদ্রাসা ছাত্রের রমজানের চাঁদ দেখার দলিলকে পুঁজি করে সরকার ঘোষিত রমজানের চ্যালেঞ্জ করেন। পরে দেখা গেলো, মুফতি আমিনীর দাবী স্বতঃসিদ্ধ নয়। তারপরও তিনি সরকার ঘোষিত দিনের এক দিন আগে রোজা শুরু করেন এবং দলবল সহ ঈদের নামাজ পড়েন।

ঘটনাটা সম্ভবত ২০০২-০৩ সালের দিকের হবে। সাল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। অনেকে বলেন এটা ২০০৬ সালের ঘটনা। আমার ধারণা, এটা আরো আগেও ঘটে থাকতে পারে। তবে ওই ঘটনা দেশে এমন পরিস্থিতির জন্ম দেয় দেয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিবৃতি দিয়ে বলেন, সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা বা ঈদের পালন হওয়া উচিত। এমনকি কোন এক ওআইসি ফোরামেও তিনি এই কথা বলেছিলেন।

সেই থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একক আধিপত্য খর্ব হতে শুরু করে। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার কতৃক প্রফেসর সালাহ উদ্দীনকে জাতীয় মসজিদের খতীব করা, পরবর্তীতে শামীম মোহাম্মদ আফজালের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক নিয়োগ হওয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতরের সময় চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি চাঁদ দেখা কমিটি তথা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে আরো বিতর্কিত করে তোলে। তবে এপ্রিলের শুরুতে কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষিতে মসজিদে মুসুল্লির গমনাগমন বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ধর্ম মন্ত্রণালয় আলোচিত হয়েছে। তারা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে, আবার কারো কারো দ্বারা সমালোচিতও হয়েছে।

আবার ময়মনসিংহ সদর আসনের এমপি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান যখন ধর্মমন্ত্রী, তখন তিনি এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। মন্ত্রীর আদেশে রাস্তার যেসব স্থানে পথচারীদের পেশাব করার প্রবণতা বেশি, সেখানে আরবীতে 'এখানে প্রস্রাব করিবেন না' লেখা হয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো আরবী তথা কোরআনের ভাষা চোখে পড়তে যেন লোকে সেখানে মূত্রত্যাগ না করে। সত্যিই প্রথম প্রথম গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে অনেক পথচারীকে শান্তিতে প্রস্রাব করতে গিয়ে সামনে আরবী দেখে সভয়ে সেখান থেকে সরে আসতে দেখা গিয়েছিলো।

সম্প্রতি সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তির পটভূমি রচনায় ধর্ম মন্ত্রণালয়কেও কাজে লাগানো হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দাওয়াতে ২০১৭ সালে সৌদি আরব থেকে পবিত্রতম দুই মসজিদ থেকে দুজন ইমাম এদেশে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁদের সংবর্ধনা দেয়া হয়, যা ছিলো আদতে একটি সরকারী ধর্ম সম্মিলন বা ইজতেমা...।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়