News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ২৪ এপ্রিল ২০২০
আপডেট: ১৬:০৫, ২৬ এপ্রিল ২০২০

বাংলাদেশের চন্দ্র দর্শন কড়চা-১

প্রথম কিস্তি

বাংলাদেশের চন্দ্র দর্শন কড়চা-১

গতকাল বৃহস্পতিবার থেকেই কার্যত মাহে রমজানের শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গতকাল থেকেই রমজানের ঘোষণা এসেছে। বাংলাদেশে আজ রমজানের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। এশার পর অনুষ্ঠিত হবে প্রথম তারাবী। করোনাভাইরাসের কারণে এবার তারাবীর নামাজ আদায়েও বিধিনিয়ম আরোপ করা হয়েছে।

ছেলেবেলা থেকে দেখতাম, প্রতিবারই যখন সরকার রমজান বা ঈদের ঘোষণা করতেন, তখন আমার আব্বা আনমনে এই ছোট্ট ঘটনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন।

তিনি ব্রিটিশ আমলের স্মৃতিচারণা করতেন। ব্রিটিশ আমলে রমজান বা ঈদের ঘোষণা করার গরজ সরকারের ছিলোনা। দিল্লী জামে মসজিদের শাহী ইমাম আবদুল হামিদ বুখারী মুঘল আমলের ঐতিহ্য ধরে রাখার অংশ হিসেবে রোজা বা ঈদের ঘোষণা প্রদান করতেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে রাতে প্রচারিত ইংরেজি খবরে বলা হতো, মোহামেডান সম্প্রদায় কাল থেকে রোজা পালন করবে, অথবা কাল মোহামেডান সম্প্রদায়ের ঈদ পালিত হবে। সরকারী প্রচারযন্ত্রের ঘোষণায় থাকতো না কোন একাত্মবোধ। যেন দায়সারাভাবে প্রতিবেশীর খবর বলে যাওয়া।

সেই খবর উপমহাদেশের যারা সরকারী হুকুম মানতো, তারা মানুষের মধ্যে প্রচার করতো। মুসলিম জমিদাররা এই কাজটা করতেন। তাঁদের যাদের কাছে বন্দুক ছিলো, তাঁরা গুলি ফুটিয়ে নিজ নিজ প্রজাদের জানাতেন। যাদের বন্দুক ছিলোনা, তাঁরা ঢোলবাদ্য বাজিয়ে এলান করতেন। গুলি ছোঁড়ার সর্বশেষ চিহ্ন বোধকরি এখন শোলাকিয়া ঈদগাহে দেখা যায়। তবে এখন গুলি ছুঁড়ে সরকার, তথা জেলা পুলিশ। গুলি ছুঁড়ে সেখানে ঈদের জামাতের ঘোষণা দেয়া হয়।

অনেকে এসব ঘোষণার গুরুত্ব দিতো না। নিজেরা চাঁদ দেখে, অথবা নিজেদের পীর সাহেবদের হুকুম মতো রোজা, ঈদ করতেন। এসবের চিহ্ন আজো এদেশে মেলে। এখনো সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী অনেকেই ঈদ করেনা।

ব্রিটিশ আমলে মুসলিমদের মধ্যে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছিলো। একটি ধারার মত ছিলো, বিধর্মীদের দখলে যাওয়ায় এদেশ দারুল হরবে পরিণত হয়েছে। সুতরাং যতোদিন ব্রিটিশ আছে, ততোদিন জুমার নামাজ আর ঈদের নামাজ পড়া যাবেনা। আরেক ধারার মতে, ব্রিটিশরা খ্রীষ্টান- মুসলিমদের সবচেয়ে নিকটবর্তী আহলে কেতাব। সুতরাং তাদের অধীনে সব করা যাবে।

আমার পিতামহের মত ছিলো এই দুই মতের মাঝখানে। তিনি মনে করতেন, এই দেশ আমাদের নিজেদের। আমরা এই মাটির জন্ম। ব্রিটিশরা আমাদের ভূমি জবরদখল করা বিদেশী। বিদেশীদের হটিয়ে স্বরাজ কায়েম করা যেমন জরুরী, তেমনি নিজের দেশে জুমার নামাজ আর ঈদের নামাজ থেকে নিজেদের বঞ্চিত রাখাও বাতুলতা।

যাহোক, আব্বাকে সবসময়ই বলতে শুনতাম, নিজেদের দেশ হয়েছে বলেই তো আজ চাঁদ দেখা কমিটি, এটা সেটা কতো কি দেখছি। মানুষ আর দেশ যেন একই সাথে উৎসব মুখরতায় একাকার হয়ে যায় এখন। অথচ আমাদের বাল্যকাল এসব অসাধারণ অনুভূতি থেকে বঞ্চিত ছিলো। আমি তখন আব্বার কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতাম না, এখন বুঝতে পারি।

বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির পাকিস্তানী সংস্করণ কেন্দ্রীয় রুয়েত হিলাল কমিটি। তবে ১৯৭৪ সালের আগে এই কমিটি স্থিরতা লাভ করেনি। আর পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে চাঁদ দেখার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলোনা। ১৯৫০ সাল পর্যন্তও দিল্লীর শাহী ইমামের ঘোষণার উপরই এদেশকে নির্ভরশীল থাকতে হতো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতীবের নেতৃত্বে একটি কার্যত আধা সরকারী চাঁদ দেখা কমিটি গঠিত ছিলো। এই কমিটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আবহাওয়া বিভাগের সাথে সমন্বয় করে চাঁদ দেখার ঘোষণা করতো। ১৯৮০ সালের ২৫ জানুয়ারী ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হবার পর চাঁদ দেখার বিষয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আরো বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানের অবয়ব লাভ করেছে।

চাঁদ দেখা, কিংবা রোজা বা ঈদ পালন নিয়ে এখন দেশে যেধরণের মেরুকরণ অথবা চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার প্রবণতা দেখা যায়, এমনটা সবসময় ছিলোনা। এর ইতিহাস খুঁজতে গেলে রাজনীতির আলোচনা আছে। সেটা আগামীকাল পরবর্তী কিস্তিতে আসবে...।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়