প্রেম, যৌনতা ও শরীর নিয়ে ছেলের প্রতি মায়ের চিঠি
এ লেখাটি ইংরেজী থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত। গুড ম্যান প্রজেক্ট ম্যাগাজিনে এ লেখাটি প্রকাশিত হয়। লিখেছেন জোয়ানা শ্রোডার। শিরোনাম- 7 Things I’m not afraid to tell my sons about love, sex, and their bodies. ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলা করেছেন শাহান আহমেদ।
আমি জানি মা হিসেবে আমি হয়ত বিরক্তিকর। কেন না আমি প্রতিবার তোমার গোসলের সময় বাইরে থেকে জানতে চাই, ঠিকঠাকভাবে শরীর পরিষ্কার করেছো কি না। এমনকি তোমার নিজের গোসল তুমি নিজে করা শিখে ওঠার পরেও হয়ত আমি এমন ছোট্ট ব্যাপার তোমাকে মনে করিয়ে দেই যা তোমাকে বিরক্ত করে।
কিন্তু এর বাইরে আজ আমি তোমাকে এমন কিছু বিষয়ে বলব যা আমার বলা কর্তব্য। শুধু তোমার মা হিসেবে নয়, ছেলে সন্তান হিসেবে যৌনতা, শরীর ও লজ্জার যে কিছু বিশেষ অনুভূতি এ সমাজ তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে সে ব্যাপারে সচেতন করতে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আমি তোমার প্রতি আমার বক্তব্য এখানে লিখছি কেন না অন্য বাবা-মারাও যেন তাদের ছেলে সন্তানের এসব ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন।
পুরুষালি হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই তোমার
পুরুষের বয়স হওয়ার আগেই ছেলেদের ওপর পুরুষালি আচরণ করার জন্য বহু চাপ থাকে। একটি ছেলে বাচ্চার বয়স দুই বছর পেরোতে না পেরোতেই অনেকেই বলতে শুরু করে ‘বাপের বেটা’, ‘ছেলে হতে হলে এমনই’, ইত্যাদি। উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই তোমাদের প্রতি এমন মন্তব্য পুরুষালি ভাবভঙ্গির স্বীকৃতি হিসেবে বলা হয়ে থাকে। আমি মনে করি একটি বাচ্চা ছেলের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা।
শুধু জেনে রাখ, বেশিরভাগ ছেলেরা যা পছন্দ করে তুমিও যদি তা পছন্দ কর; তবুও পুরুষ হতে হলে তোমাকে যা যা করতে বলা হয়েছে তার সবটাই করার প্রয়োজন নেই তোমার। অন্যরা যেসব আচরণকে মেয়েসুলভ বলে থাকে এমন কিছু যদি তুমি করতে পছন্দ কর, তবে শুনে রাখো আমাদের তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি গোলাপি রঙের জামা পরো বা না পরো, এটা আসলে শুধুমাত্র অন্যসব রঙের মত একটি রঙ। তুমি ফুটবল খেলা পছন্দ করো বা না করো, তুমি নেইল পলিশ ব্যবহার করতে পছন্দ করো বা না করো এর কোনটাই তোমাকে মেয়েলি বা পুরুষালি হতে সাহায্য করবে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এসব ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্ত একান্তই তোমার। তোমার পছন্দ অপছন্দ আমরা ঠিক করে দেওয়ার কেউ নই। জেনে রেখো তোমাকে পুরুষ হয়ে উঠতে চাপ দিচ্ছে এই সমাজ। তোমাকে কঠোর হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কিন্তু তাতে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি চাইলে কাঁদতে পারো। বিশ্রাম নাও, আমরা সবসময় তোমার পাশে আছি।
তোমার শরীর স্বাধীন, একচ্ছত্র অধিকার শুধু তোমার
শরীরের স্বাধীনতা? এর মানে কী ? এর মানে হলো তোমার শরীরের অধিকার তোমার। তোমাকে যদি কেউ জড়িয়ে ধরে আর তোমার তা ভাল না লাগে তুমি আমাদের জানাতে পারো।
সবচেয়ে ভালো হলো তুমি এমন মানুষের সঙ্গে চলবে যারা কারো শরীরে স্পর্শ করার আগে অনুমতি নেয়ার মতো যথেষ্ট সভ্য। আমরা বিশ্বাস করি তোমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ তোমার। তোমার লিঙ্গ ও যৌনতা, এমনকি তোমার যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশের বিষয়টিও তোমার নিজস্ব ব্যাপার।
কারো সম্মতি ছাড়া কখনই কারো শরীরে স্পর্শ করবে না
তুমিও কাউকে তার সম্মতি ছাড়া কখনই স্পর্শ করবে না। তোমার হাত নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এর অর্থ হলো তোমার হাত যেন অন্যের অসুবিধার কারণ না হয়। তুমি যদি কাউকে স্পর্শ করতে চাও তবে আগে জিজ্ঞেস করে নাও। এমনকি তুমি যখন ডেটিং শুরু করবে তখন কাউকে স্পর্শ করতে চাইলে বা চুমু খেতে চাইলে তাকে আগে জিজ্ঞেস করে নাও তুমি কি তাকে চুমু খেতে পারবে কিনা? এমনভাবে জিজ্ঞেস করো যেনো আবেদন থাকে সেই জিজ্ঞাসায়। আবার তাকে স্পর্শ বা চুমু খেতে গিয়ে তার ‘না’ বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না। কারো ‘না’ বলা পর্যন্ত এগিয়ে যেও না। যদি সে ‘না’ বলে তাহলে বুঝো যে তুমি এমন কিছু করছো যার জন্য তোমার অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এমন মানুষের কাছে সম্মতি চাইতে যেও না, যে সম্মতি দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। এটা যদিও খুব সহজ কথা তবুও মনে রাখার জন্য বলে রাখলাম।
আমি জানি তুমি যেদিকেই তাকাও, শক্ত পেশি ও সরু কোমরের পুরুষ দেখে থাক। তুমি হয়ত স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যানের এখন সরু কোমর আর পেশিবহুল সিক্সপ্যাক শরীর দেখছো। তবে তোমার জেনে রাখা ভালো, একসময় এই চরিত্রগুলোর অভিনেতারা সাধারণত দেখতে পুরুষের মতোই শরীর ছিলেন। আজকাল উইলভারিনের হিউ জ্যাকমেন পুরুষালি মডেল হিসেবে নাম করেছেন। কিন্তু তোমার এটাও জেনে রাখা ভালো, সিনেমাতেও তিনি একজন সাধারণ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেননি। তিনি একজন মিউট্যান্ট হিসেবে অভিনয় করেছেন। জ্যাকম্যানের এই পেশিবহুল শরীর তৈরিতে তাকে দিনের পর দিন দক্ষ প্রশিক্ষক ও পুষ্টিবিদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। এরকম শরীর বানানো তার পেশাদারিত্বের অংশ। তার মতো দেখতে তোমাকেও হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কেন না এটা তোমার পেশা নয়। জ্যাকের মতো তোমার শরীর হওয়ার প্রয়োজন নেই। এরকম শরীর ছাড়াও মানুষ তোমাকে পছন্দ করবে, তোমার বন্ধু হবে, তোমার সঙ্গে ডেট করবে। তুমি তোমার শরীরের প্রতি এমনভাবে যত্ন নেবে যাতে দীর্ঘদিন তুমি সুস্থ থাক। প্রয়োজনীয় শরীরচর্চা করবে ও তোমার শরীরের জন্য উপযুক্ত পুষ্টির যোগান দেবে।
মনে রেখ, একজন মডেলের মতো পুরুষালি শরীর হওয়ার প্রয়োজন নেই তোমার, শুধু তুমি তোমার নিজের মতো হও, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও। তোমার শরীরের আকার বা গঠন নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
মাদক নেবে না
তুমি হয়তো ভাবছো আমি আর তোমার বাবা যৌন ও যৌনতার ব্যাপারে যত উদার উপদেশ দিচ্ছি মাদকের বেলায়ও তাই হব? না। তা হতে যাচ্ছে না।
তোমার আশেপাশের বন্ধুবান্ধবদের হয়তো মাদক নিতে দেখবে তুমি। তুমি হয়ত মাদক কেমন তা একবার পরীক্ষা করতে চাইবে। কিন্তু জেনে রেখো, এই পরীক্ষা পর্ব থেকে তুমি কতদূর গড়াবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এর পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
মাদক গ্রহণ ছাড়া পৃথিবীতে আরও হাজার ধরনের কাজ আছে যা তোমাকে উত্তেজিত করবে। তুমি বাইক রাইডিং করতে পারো, নতুন ভিডিও গেম খেলো, থিয়েটারের হাজার মানুষের সামনে অভিনয় করো এরকম হাজার কাজ আছে যা তোমাকে উত্তেজনার চরমে পৌঁছাবে।
মাঝে মাঝে একা থাকা ভালো
মাঝেমাঝে একা থাকলে ভালো লাগে, এটা সবাই জানে। তবুও আমি তোমাকে এটা বিশেষভাবে আবার বলব। মনে রাখবে, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু সবসময় তোমার আশেপাশে বন্ধুবান্ধবের হইহুল্লোড় থাকবে না। তাই সবচেয়ে ভালো হলো নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে প্রতিদিন কোনো একটি সময় একেবারে একা কাটাও তুমি। সব ধরনের প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম থেকে একটা সময়ের জন্য দূরে থাকো। এ সময় অবশ্য তুমি পড়তে পারো, ভাবতে পারো, লিখতে পারো, মেডিটেশন করতে পারো। তুমি যা করতে পছন্দ করো তা একা এই সময়ে যদি করো তবে তা তোমাকে শান্ত ও মনযোগী হতে সাহায্য করবে। তুমি নিজেকে সম্মান করতে শিখবে তাতে। তোমার যদি কোনো প্রেমিক বা প্রেমিকা হয়ে ওঠে, তবে আমরা জানি একা থাকা কঠিন। কিন্তু মনে রাখবে তুমি একাই তোমার নিজের জন্য যথেষ্ট। তাই নিজেকে সময় দাও।
তোমার আকাঙ্ক্ষার জন্য লজ্জিত বা ভীত হবে না, এটা স্বাভাবিক, কিন্তু…
তুমি যখন বড় হতে থাকবে তখন খুব স্বাভাবিকভাবে তোমার মধ্যে যৌনতার প্রতি আগ্রহ জন্ম নেবে। তোমার শরীরে কাম উত্তেজনা জাগবে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যৌনতার দিক থেকে তুমি হয়ত সমকামী বা উভকামি অথবা একজন হিজড়াও হতে পারো। এই স্বাভাবিক বিষয়কে অনেকেই অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করবে তোমার কাছে। যা মোটেও ঠিক নয়। মানুষ তার নিজের অদ্ভুত লজ্জার অনুভূতি তোমার উপর চাপাতে চাইবে। তাদেরকে পাত্তা দিও না।
তোমার যৌন চাহিদা যেরকমই হোক, তুমি খুবই ঠিক আছো। তুমি যখন প্রবল যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করবে তখনও তুমি ঠিক আছো। এটা স্বাভাবিক। অনুভূতি শুধুই অনুভূতি। আমরা কী অনুভব করবো তা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য আমাদের নেই। তবে আমরা কী আচরণ করব তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে।
তুমি কত গভীরভাবে কাউকে চাও বা কত দৃঢ়ভাবে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করার ইচ্ছা জাগে তোমার মনে, তা দিয়েও তুমি অন্য কারো মনোযোগ বা যৌন সাড়া পাওয়ার অধিকার রাখো না। তাই তোমার আচরণ হতে হবে সভ্য। কারো জন্য তোমার যতই প্রবল কামনা বাসনা জন্ম নিক, তবুও তাকে বিরক্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই।
তোমাকে হয়ত অনেকে বলবে, প্রেম ও যৌনতায় দুজনের অতো বেশি বোঝাপড়া না থাকলেও চলে। হয়ত অনেকেই খুব একটা বোঝাপড়া তৈরি না করেও যৌন সঙ্গম উপভোগ করে। তবে একটি সুস্থ ও উপভোগ্য যৌন জীবনের জন্য তোমাকে সঙ্গীর প্রতি সৎ হতে হবে। উদারতা থাকতে হবে। এবং তোমার সঙ্গী ও নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে সচেতন থাকবে।
আকাঙ্ক্ষা ও কামনা দারুণ ব্যাপার। এ নিয়ে আলোচনা করা মোটেও দোষের বা লজ্জার নয়।
[শব্দনীলের (Shobdo Nill) ফেসবুক পোস্ট]
নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ