খেলাধুলায় এগিয়েছে, এক হয়েছে দেশ
ঢাকা: গৌরবদীপ্ত স্বাধীনতার ৪৪তম বার্ষিকী উদযাপন করলো বাংলাদেশ। এই ৪৪ বছরে বিভিন্ন খাতে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। আরও অনেক বিষয়ে আমরা উন্নতির পথে। সে তুলনায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে পাকিস্তান।
অর্থ-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি আর শিক্ষায় যেমন বাংলাদেশ এগিয়েছে, তেমনি এগিয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। তবে সবচেয়ে বেশি আমাদের সফলতা এসেছে ক্রীড়াঙ্গনে।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়েছে, জাতি বিভক্ত হয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু বারবার বাংলার সব মানুষের হৃদয়, কণ্ঠ এক হয়েছে এই খেলাধুলার কারণেই।
ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে ক্রিকেটে। বাংলার দামাল ছেলেরা ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তিগুলোকে বারবার মাটিতে নামিয়েছে অনায়াসে। ক্রিকেটের মধ্যে দিয়েই আমরা সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি পরিচিত হতে পেরেছি। ক্রিকেট দুনিয়ায় মাশরাফি-সাকিবরা এখন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। সবাই তাদের এক নামে চেনে।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের টাইগাররা স্বপ্ন পুরণ করেছে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয় টাইগাররা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে হারলেও সে হার বিতর্কিত হয়েছে দুনিয়াজুড়েই। আর তাই বীরের মতোই দেশে ফিরেছে মাশরাফির বিন মর্তুজার টিম বাংলাদেশ।
টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে টাইগারদের আগমন বেশি দিনের নয়। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৯৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নেয় টাইগাররা। প্রথম বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ৬২ রানে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পায়।
এরপর ২০০০ সালের টেস্ট আঙিনায় পা রাখে বাংলাদেশ ক্রিকেট। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আন্তার্জাতিক ক্রিকেটে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায় ১৯৮৬ সালে। ওয়ানডে ক্রিকেটে যাত্রার ১৩ বছর পর ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে প্রথম জয়।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের ক্রিকেটে বাংলাদেশ ২০১১ সালে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার। ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার পরের দিন আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে ছালমা খাতুনরা।
২০১০ সালে চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে শ্রীলংকাকে হারিয়ে স্বর্ণ জিয় করে বাংলাদেশ। এশিয়ান গেমসে স্বপ্ন জয়ে টাইগারদের দলের নেতৃত্ব দেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোহামাদ আশরাফুল। এছাড়া ক্রিকেটে অনেকগুলো বড় বড় সাফল্য এসেছে টাইগারদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে বেশ কয়েক বার বাংলাওয়াশ করে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক ও রিয়াদরা।
২০১১ সালে ভারত এবং শ্রীলংকার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজক ছিলো বাংলাদেশ। গত বছর ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপের একক আয়োজক বাংলাদেশ।
ক্রিকেটের মত অন্য খেলায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। বাংলাদেশের গলফার সিদ্দিকুর রহমান সাফল্যের সঙ্গে সারা দুনিয়ায় বিচরণ করছেন। স্বাধীনতার পর আমরা দাবায় পেয়েছি ছয়জন গ্র্যান্ড মাস্টার। আরও বেশ কয়েকজন গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার পথে। বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার। দাবায় মহিলাদের মধ্যে রানী হামিদের সুনাম রয়েছে সারা দুনিয়ায়। টেবিল টেনিসে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশের জোবায়দা নিলু। মাগুরার আব্দুল হালিম ফুটবল মাথায় নিয়ে হেঁটে গিনেস বুকে জায়গা করে নিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার সব চেয়ে বড় গেমস এসএ গেমস। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপকে নিয়ে এ পর্যন্ত তিনবার এককভাবে এ গেমসের আয়োজক ছিলো বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালের এসএ গেমসে ৯টি স্বর্ণ, ১৯৯৩ সালে ১১টি স্বর্ণ ও ২০১০ সালে ১৮টি স্বর্ণ পদক লাভ করেছে বাংলাদেশের লাল সবুজের প্রতিনিধিরা।
২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একাদশ এসএ গেমসে ৯৭টি পদক জিতে আট জাতির মধ্যে তৃতীয় হয় বাংলাদেশ। ১৮টি স্বর্ণের মধ্যে ৪টি কারাতে ও শুটিংয়ে তিনটি স্বর্ণ জেতে বাংলাদেশ। এছাড়া উশু, বক্সিং, তায়কায়ন্দো ও গলফে দুটি করে এবং ফুটবল, ক্রিকেট ও ভারোত্তোলনে একটি করে স্বর্ণ জিতে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা।
বাংলাদেশ কাবাডি, হকি এবং অ্যাথলেটিক্সও বাংলাদেশে উন্নতি করেছে। ১৯৮৫ সালের এসএ গেমসে বাংলাদেশের সাঁতারু মোশারফ হোসেন একাই ৬টি স্বর্ণ পদক জিতেছিলেন। এছাড়া কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের শুটাররা বেশ কয়েকবার স্বর্ণ জিতেছেন।
সাবেক ক্রিকেটার ও মুক্তিযোদ্ধা রকিবুল হাসান বলেন, “স্বাধীনতার পর আমরা সব কিছুতেই এগিয়েছি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছি খেলাধুলায়। তার মধ্যে ক্রিকেটে আমাদের বেশি উন্নতি হয়েছে। আমাদের খেলাধুলার উন্নতি শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। আমার এখনও মনে আছে, পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা যুদ্ধ শেষ করলাম। যুদ্ধের পর আমাদের অনেক কিছুই ছিলো না। আমাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়। খেলাধুলার উন্নতির পেছনে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনেক বেশি।”
এছাড়া তিনি বলেন, “দেখতে দেখতে আমরা স্বাধীনতার আরও একটি বছর পার করলাম। স্বাধীনতার এখন ৪৪ বছর। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। খেলাধুলার উন্নতির জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আলাদা করতে হবে। খেলার জন্য এখন আলাদা মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এটা করতে পারলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো। এ জন্য সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।”
এছাড়া ক্রিকেটের উন্নতি নিয়ে তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর আমরা সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছি ক্রিকেটে। এইতো বিশ্বকাপ শেষ করলাম। ক্রিকেট ছাড়াও আমরা ফুটবলে উন্নতি করেছি। গলফের উন্নতি করেছি, হকিতে উন্নতি করেছি, দাবায় উন্নতি করেছি। সত্যি বলতে আমরা কিন্তু অনেক বেশি এগিয়েছি। আর এই খেলাধুলার মাধ্যমেই আমরা ১৬ কোটি মানুষ এক হতে পেরেছি।”
এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমাদের চেয়ে পিছিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাকিস্তান কতটা পিছিয়েছে সেটা বলতে চাই না। আমি বলতে চাই, আমরা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি এগিয়েছি। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। আরও উন্নতি করতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে।”
এ বিষয়ে সাবেক খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়নের এ গতির ছন্দ বজায় থাকেনি সব সময়। এ অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চলেছে বারবার। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য ব্যক্তির কারণে উন্নয়নে ছেদ পড়েছে। না হলে হয়তো এই বিশ্বকাপ আমাদেরই হতো।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসএস/
নিউজবাংলাদেশ.কম