সুরা আনআ’মের নানা বৈশিষ্ট্য, দিক ও ঘটনা
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন। তবুও কাফেররা নিজ পালনকর্তার সাথে অন্যান্যকে সমতুল্য স্থির করে।"
الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِم يَعْدِلُونَ
সুরা আনআ`মের প্রথম আয়াতের অর্থ শুনলেন। এই আয়াতের মাধ্যমে তিন ধরনের কাফিরদের অবাস্তব ধারণাগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে: প্রথমত যারা মনে করে কোনো জিনিসেরই স্রস্টা নেই, সব কিছুই নিজ থেকেই সৃষ্ট। এরা হল নাস্তিক। দ্বিতীয়ত যারা মনে করে অন্ধকার ও আলোই হচ্ছে সব কিছুর স্রস্টা। তৃতীয়ত অংশীবাদীদের দল যারা মনে করে মূর্তিগুলো আল্লাহর অংশীদার বা শরিক।সুরা আনআ`ম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সুরার মোট আয়াতের সংখ্যা ১৬৫। মাক্কি সুরায় সাধারণত ইসলামী চিন্তাধারার মূল বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। সুরা আনআ`ম কুরআনের ষষ্ঠ সুরা। এই সুরা এমন সময় মক্কায় নাজিল হয়েছিল যখন মুশরিকরা ইসলামের আহ্বান উপেক্ষা, নাকচ ও প্রতিরোধের জন্য ব্যাপক কঠোরতা আরোপ করেছিল। তাই অন্য অনেক মাক্কি সুরার মত এ সুরাও মূলত ইসলামের তিনটি প্রধান মূলনীতি তথা একত্ববাদ বা তাওহিদ, নবুওত ও পরকালসহ অন্যান্য বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে একত্ববাদ। মহান আল্লাহ যে এক ও অদ্বিতীয় তার নানা প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে আল্লাহ বিশ্ব-জগতের স্রস্টা, মালিক ও পরিচালক। শিরক ও মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে লড়াই এ সুরার অন্যতম লক্ষ্য।
পুরো সুরা আনআ`ম পবিত্র কাবা ঘরের কাছে বিশ্বনবী (সা.)`র কাছে এক বারেই নাজিল হয়েছিল। এর সঙ্গে একই সময় মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ৭০ হাজার ফেরেশতাও নাজিল হয়েছিল।
অহংকার ও স্বার্থপরতাই হচ্ছে মূর্তি পূজা বা শিরকের উৎস। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে মুশরিকদের সতর্ক করে দিয়ে এই সুরার পঞ্চম আয়াতে বলছেন:
أَلَمْ يَرَوْاْ كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ مَّكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّن لَّكُمْ وَأَرْسَلْنَا السَّمَاء عَلَيْهِم مِّدْرَارًا وَجَعَلْنَا الأَنْهَارَ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَنْشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ قَرْنًا آخَرِينَ
"তারা কি দেখেনি যে, আমি তাদের আগে কত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলাম, যা তোমাদেরকে দেইনি। আমি আকাশকে তাদের উপর অনবরত বৃষ্টি বর্ষণ করতে দিয়েছি এবং তাদের তলদেশে নদী সৃষ্টি করে দিয়েছি, অতঃপর আমি তাদেরকে তাদের পাপের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের পরে অন্য সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছি।"
খোদাদ্রোহীদের ও সত্য অস্বীকারকারীদের পরিণতি কি হয়েছে তা দেখার জন্য মহান আল্লাহ মানুষকে ভ্রমণ করার ও এ নিয়ে চিন্তাভাবনার পরামর্শ দিয়েছেন।
সুরা আনআ`মের ১১ নম্বর আয়াতে মহানবী (সা.)-কে আল্লাহ বলছেন:
قُلْ سِيرُواْ فِي الأَرْضِ ثُمَّ انظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
"বলে দিন: তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ, মিথ্যারোপকারীদের তথা আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হয়েছে?"
অতীতের জাতিগুলোর নানা নিদর্শন দেখার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে ভালোভাবে বুঝতে পারে।
এই সুরার নাম আনআ`ম রাখার কারণ হল, এতে চতুষ্পদ জন্তু ও গৃহপালিত পশু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ সুরার ১৩৭ নম্বর আয়াত থেকে ১৪৫ নম্বর আয়াতে চতুষ্পদ জন্তু ও গৃহপালিত পশু সম্পর্কে কাফিরদের নানা ভুল ধারণা এবং কুসংস্কারের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
মহান আল্লাহ এই আয়াতগুলোতে বলেছেন:
"আল্লাহ যেসব শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো থেকে তারা এক অংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে; এরপর নিজ ধারণা অনুসারে বলে এটা আল্লাহর এবং এটা আমাদের অংশীদারদের। এরপর যে অংশ তাদের অংশীদারদের, তা তো আল্লাহর দিকে পৌঁছে না এবং যা আল্লাহর তা তাদের উপাস্যদের দিকে পৌঁছে যায়। তাদের বিচার কতই না মন্দ।"
মহান আল্লাহ আরো বলছেন:
"এমনিভাবে অনেক মুশরেকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করত না। অতএব, আপনি তাদেরকে এবং তাদের মনগড়া বুলিকে পরিত্যাগ করুন। তারা বলে: এসব চতুষ্পদ জন্তু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ। আমরা যাকে ইচ্ছা করি, সে ছাড়া এগুলো কেউ খেতে পারবে না, তাদের ধারণা অনুসারে। আর কিছুসংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে আরোহন হারাম করা হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর উপর তারা ভ্রান্ত ধারনা বশত: আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তাদের মনগড়া বুলির কারণে, অচিরেই তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। তারা বলে: এসব চতুষ্পদ জন্তুর পেটে যা আছে, তা বিশেষ ভাবে আমাদের পুরুষদের জন্যে এবং আমাদের মহিলাদের জন্যে তা হারাম। যদি তা মৃত হয়, তবে তার প্রাপক হিসাবে সবাই সমান। অচিরেই তিনি তাদেরকে তাদের মিথ্যাচারের জন্য শাস্তি দেবেন। তিনি প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী। নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজ সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতাবশতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চিতই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি। "
পর্ববর্তী জাতিগুলোর শিক্ষামূলক ঘটনা, ইহুদিদের অসার অবাস্তব প্রশ্ন ও তার জবাব, বিশ্বনবী (সা.)-কে ধৈর্যধারণের উপদেশ, কাফিররা ঈমান আনবে – নবী (সা.)`র এমন প্রত্যাশা, কাফিরদের নিয়ামত দিয়ে অবকাশ দেয়া, ঐশী বিধানের রদ-বদলের বিষয় নবীরও অজানা, অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহর কাছেই রয়েছে, ধর্মীয় বিষয়ে ধনী-দরিদ্ররা সমান-এসব হল সুরা আনআমের কিছু প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়াও কিয়ামতের দিনে কাফিরদের অনুতাপ, মৃত্যুর ফেরেশতার মাধ্যমে রুহ কবজ করার ধরণ, অসার বিতর্ক থেকে দূরে থাকা, কাফিরদের প্রতি গালিগালাজ নিষিদ্ধ, আল্লাহর নাম না নিয়ে জবাই করার পশুর মাংস খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, অপচয় করা, অবৈধভাবে হত্যা করা নিষিদ্ধ ও অন্যের সম্পদ আত্মসাত করা নিষিদ্ধ ইত্যাদিও সুরা আনআ`মের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
টিআর/
নিউজবাংলাদেশ.কম