News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ১২ মার্চ ২০১৫
আপডেট: ১৫:৩৯, ২২ জানুয়ারি ২০২০

পুলিশ তুমি মানুষ হও

পুলিশ তুমি মানুষ হও

এর চেয়ে নির্মম আর কী হতে পারে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত পুলিশ বাহিনীর নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হচ্ছে সেই জনগণই! স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে আসা একটি জাতির মূল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এ বিচ্যুতি অস্বাভাবিক, অকল্পনীয়।

সারাবিশ্ব এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের দিকে, অগ্রগতি ও প্রগতির দিকে। উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামো’ নয়; উন্নয়ন মানে মানসিকতার উন্নয়ন, চেতনার উন্নয়ন, চিন্তার উন্নয়ন, সৃজনশীলতার উন্নয়ন, গণতন্ত্রের উন্নয়ন, পরমত সহিষ্ণুতার উন্নয়ন, সর্বোপরি মানবিকতার উন্নয়ন। এমনকি এই আমাদের দেশেইতো রাস্তার ধারের কিংবা পার্কের মধ্যের কোনো গাছ কেটে ফেললে সমালোচনা হয়, গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়। সভ্যতা এখন শুধু মানুষের নয়; অহেতুক গাছের প্রাণহানিও মেনে নেয় না। জাহাজের তেলে সুন্দরবনের ক্ষতি দেখতে ছুটে আসে জাতিসংঘও। স্কুলে কোনো শিশুকে শিক্ষক প্রহার করলে রাস্তায় মানববন্ধনে হয় তার প্রতিবাদ। প্রগতির এমন বিকাশের সময় এ হতেই পারে না যে, পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষ মারা যাবে অহরহ। মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার পুলিশ ক্রমাগত পরিণত হচ্ছে ভয়ের মূর্তিতে। ‘জনগণেরবন্ধু’ পুলিশ হারিয়ে ফেলছে জনগণের বিশ্বাস।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পুলিশের সমস্ত দায়বদ্ধতা থাকা উচিৎ জনগণের কাছে। কারণ জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। রাজনৈতিক সরকার আজ আসে কাল যায়। কিন্তু রাষ্ট্র এবং তার জনগণ তো ধ্রুব। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন উচ্চমার্গে পৌঁছায়নি যে পুলিশবাহিনী এবং অন্যান্য আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ‘রাজনীতিমুক্ত’ হয়ে যাবে। সেই আশা করাও হচ্ছে না। কিন্তু একেবারেই রাজনীতি করছেন না, সাধারণ মানুষ- তারা কেন পুলিশের হয়রানির শিকার হবেন।

আর যারা রাজনীতি করেন, তাদের রাজনৈতিক ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তার করতে পারেন। কিন্তু বিনা বিচারে মেরে ফেলার সংস্কৃতি এমন সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না, যারা ৪০ বছর ও ৩৬ বছর আগের অপরাধের বিচার করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার বয়ান করে বাহবা নেয়। যত বড় অপরাধীই হোক, তাকে বিনা বিচারে মেরে ফেলা কোনোভাবেই কম অপরাধ নয়। পুলিশ এই অপরাধটি নিয়মিতই করে যাচ্ছে।

অতি সম্প্রতি রাজধানীর কাজীপাড়ায় চার যুবকের মৃতদেহ পাওয়ার পরে পুলিশ বলেছে, গণপিটুনিতে তারা মারা গেছে। অথচ প্রায় সবগুলো পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, নিহতদের একজনের শরীরে ১৮টি, একজনের ১৬টি, আরেকজনের শরীরে ২১টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। একজনের কথা পুলিশ স্বীকার করেছে যে, সে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে। তিনজন ‘গণপিটুনিতে’ মারা গেছে অর্থাৎ জনগণ মেরেছে, আর অন্যজন ক্রসফায়ারে মানে তাকে বাঁচাতে আসা সহযোগীদের সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে গুলিতে মরেছে (সেই গুলিটি পুলিশের নয়; মৃতের সহযোগীদের!)।

বাংলাদেশের একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এই গল্প বিশ্বাস করবে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ মরছে ‘ক্রসফায়ারে’। প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ, যাদের একটা বড় অংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। কয়েকদিন আগেই এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে হল থেকে বের হতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত আবার সেই কিশোর ছেলেটির তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে! সত্যিই, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!”

এতটা বেপরোয়া কেন হলো পুলিশ? রাজনীতির দায় অনেক। বাকিটা বাণিজ্যিক। অভিযোগ আছে- গ্রেপ্তারের নামে, রিমান্ডের নামে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’ করছে পুলিশ। একদিকে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা, অন্যদিকে পুলিশের কর্তাদের বেপরোয়া উস্কানি। “হাতে বন্দুক দেয়া হয়েছে ডানগুলি খেলার জন্য নয়”, “একটা লাশ পড়লে তিনটা লাশ ফেলার সামর্থ পুলিশ রাখে”, আরো কতো ধরনের বক্তব্য! এর সঙ্গে একদিকে আছে নিজেকে সরকারের অনুগত দেখানোর প্রমাণ, অন্যদিকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতার পালাবদল ঠেকনোর চেষ্টা এই ভয় থেকে যে ক্ষমতার পালাবদল হলে কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে। সব মিলিয়ে পুলিশ এতো মরিয়া। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে, যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা মারার মতো ক্ষমার অযোগ্য পাপ যারা করছে, তাদেরকে অবশ্যই দমন করতে হবে। কিন্তু সেটি হতে হবে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।

একজন সন্ত্রাসীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারকে নষ্ট করার অধিকার রাষ্ট্র পুলিশকে দেয়নি।

নিঃসন্দেহে পুলিশের অনেক ভালো কাজ রয়েছে। অনেক ভালো পুলিশও আছেন। কিছুসংখ্যক পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি সংকটে। তাদের কাছেই আমাদের আবেদন- মানুষ হয়ে উঠুন। মানুষের জীবন নিয়ে আপনি কেন খেলছেন যেখানে আপনি জানেন যে আপনার জীবনটাও চীরস্থায়ী নয়। ক্ষমতা, বিত্ত-বৈভব, এবং জনগণের পয়সায় কেনা আপনার হাতের ওই বন্দুকটি- কোনোটিই আপনাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে না। মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, স্বজন হারানোর কান্নার অনুভূতি নিজের মধ্যে ধারণ করবার চেষ্টা করুন। যে জীবন আপনি সৃষ্টি করতে পারেন না, সেই জীবন এতো অবলীলায় নিয়ে নিচ্ছেন- প্রকৃতি এই নিষ্ঠুরতাকে পছন্দ করে না। প্রকৃতির প্রতিশোধ ভয়াবহ হয়। তাই নিজের বিবেক দিয়ে প্রজাতন্ত্রের সেবা করুন। রাজনৈতিক চাপ থাকলে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে চাকরি ছেড়ে দিন।

প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আমি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কোনো না কোনোভাবে আমার জীবন চলেই যাবে। বিশ্বাস করুন, পুরো জাতি আপনাকে নিয়ে গর্ব করবে।


লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক

রফিকুজজামান রুমান

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়