News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৮ মার্চ ২০১৫
আপডেট: ১২:৩৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

আলোচনার কেন্দ্রে খালেদার গুলশান কার্যালয়

আলোচনার কেন্দ্রে খালেদার গুলশান কার্যালয়

ঢাকা: রাজধানীর অভিজাত ও কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশান। এই এলাকার ৮৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত ৬ নম্বর বাড়ি। এ বাড়িতেই দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়। এখানেই প্রথমে অবরুদ্ধ এবং পরে স্বেচ্ছায় দুই মাস ধরে অবস্থান করছেন বিএনপি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার সাথে দলের নেতাকর্মী, কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সদস্যরা রয়েছেন। এখান থেকেই ৫ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। সেই আন্দোলন কর্মসূচি এখনও চলমান।

 

গত দু’মাস ধরে এ কার্যালয় থেকেই সারাদেশের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও আন্দোলন মনিটরিং করছেন খালেদা জিয়া। এই দু’মাসে এ কার্যালয় ঘিরে নানা ঘটনার জন্ম হয়েছে। আর তাতেই অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই বাড়িটি। কি ঘটছে এই বাড়িতে, তা জানতে সারাদেশে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি সকল সংবাদ মাধ্যম, এমনকি বহির্বিশ্বের দৃষ্টিও এখন এই বাড়ির ওপরই নিবদ্ধ।

এমন পরিস্থিতিতে উত্তেজনার পারদ আরও বাড়িয়ে দিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ৪ মার্চ তা বহাল রাখেন আদালত।


এরই মধ্যে খালেদার কার্যালয়ে তল্লাশি করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন আদালত। শুরু হয় খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার ও কার্যালয়ে তল্লাশির গুঞ্জন। এরপর থেকে এই কার্যালয়কে ঘিরে আরও কৌতুহলের সৃষ্টি হয়।

 

আদালতের নির্দেশনায় খালেদাকে গ্রেফতার করা হবে কি না, কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হবে কি না কিংবা কখন করা হবে এসব বিষয় নিয়ে সারাদেশের নেতাকর্মী ও জনগণের মাঝে এখন চলছে নানামুখী চুলচেরা বিশ্লেষণ।


জানা যায়, স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দিনের তুলনায় সন্ধ্যা-রাতে নেতাকর্মীদের ভিড় জমে উঠত গুলশান কার্যালয়ে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া মূলত রাতেই এ অফিসে তার দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আর তার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতো। আসত দলের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের নেতারাও। অনেক রাত পর্যন্ত তারা বৈঠক ও রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করত। কিন্তু তখনও এত গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি গুলশানের এ রাজনৈতিক কার্যালয়।

ঘটনা প্রবাহ

গত ৩ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তনের সাথে সাথে এ কার্যালয়কে ঘিরে নানা নাটকিয়তার জন্ম হতে থাকে। ওই দিন স্বাভাবিক নিয়মেই রাতে কার্যালয়ে আসেন খালেদা জিয়া। এরপর সংবাদ পেয়ে নয়াপল্টন এলাকায় প্রধান কার্যালয়ে অসুস্থ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে যাওয়ার চেষ্টা করার পর থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েন। খালেদাকে ওই সময়ে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ইট-বালুভর্তি ১১টি ট্রাক, রায়ট কার, এপিসি, জলকামান ও পুলিশ ভ্যান মোতায়েন করা হয়। ৮৬ নম্বরের দুই প্রান্তে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে কার্যালয়ের মূল ফটকসহ অন্য ফটকেও তালা মেরে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এরপর ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তির নির্ধারিত কর্মসূচি পালনেও তাকে আর বের হতে দেয়া হয়নি। ওইদিন বিকালে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশি বাধা পেয়ে গেটে দাঁড়িয়েই সরকার পতনের দাবিতে এবং সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া, যা প্রায় দুই মাস ধরে চলছে।

এর তিনদিন পর বালুর ট্রাকের ব্যারিকেড সরালেও ওই সড়কের দুইপ্রান্তে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বহাল রাখা হয়। এরপর ১৯ জানুয়ারি ভোররাতে হঠাৎ করেই ওই সড়ক থেকে জলকামান ও পুলিশ ভ্যানের ব্যারিকেড সরিয়ে নেয়া হয়। খুলে দেয়া হয় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা। কমিয়ে আনা হয় পোশাকধারী পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা। তবে কার্যালয়ের তিন দিকে কিছুটা দূরে সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

 

এরপরও স্বস্তি মেলেনি ওই কার্যালয়ের বাসিন্দাদের। এবার মুখোমুখি হতে হয় নতুন বিড়ম্বনার। ৩০ জানুয়ারি মধ্য রাতে খালেদার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় ‘উপরের নির্দেশে’। একইসঙ্গে বিটিআরসি থেকে চিঠি দিয়ে ওই এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ৮৬, ৮৮ ও ৯০ নম্বর সড়কের বাসিন্দারাও বিপাকে
পড়ে। প্রয়োজনীয় কথা বলতে না পারায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান তারা। বাধ্য হয়ে ওইসব সড়কে অবস্থিত ডেনমার্ক, জাপান, মিসর, থাইল্যান্ড, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দূতাবাস লিখিত অভিযোগ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর প্রেক্ষিতে ১১ দিন পর সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করায় সমালোচনার মুখে ১৯ ঘন্টা পর আবার সংযোগ দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

 

এদিকে এক বিড়ম্বনা শেষ হতে না হতেই আরেক বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন তারা। ১১ই জানুয়ারি রাত থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কার্যালয়ে খাবার প্রবেশ ঠেকাতে ৮৬ নম্বর সড়কের দুই প্রান্তে আবারও সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা বসানো হয়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক মাসব্যাপী প্রায় প্রতিদিনই দফায় দফায় খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের ঠেকাতে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সতর্ক অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।


বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান নিউজবাংলাদেশকে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশের উপর কড়াকড়ি অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। মূল ফটকে রেজিস্টার খাতা নিয়ে প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করছেন তারা। ম্যাডামের পারিবারিক লোকজন ও কর্মচারী ছাড়া কেউ কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারছেন না। তাদের প্রবেশের আগেও ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। এখনও খাবার প্রবেশেও বাধা দেয়া হচ্ছে। শুকনা খাবার খেয়ে দিনযাপন করছেন কার্যালয়ে অবস্থানরতরা।


তিনি জানান, ম্যাডাম (খালেদা) ভালো আছেন। আন্দোলন আরো জোরদার করার বিষয়ে কঠোর মনোভাব তার। নামাজ পড়ে, বই-পত্রিকা পড়ে, কার্যালয়ে অবস্থানরত ও সারাদেশের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে দিন কাটছে তার। এছাড়া সপ্তাহে একবার বড় ছেলে ও কোকোর স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে কথা বলেন তিনি।

আতঙ্কিত অবরুদ্ধ এলাকার বাসিন্দারা

অস্থিরতার কারণে গত দুই মাস ধরে প্রায় বন্ধ রয়েছে ৮৬ নম্বর সড়কের গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। নাশকতার আশংকায় শিক্ষার্থীরা না আসায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা হাজিরা দিয়েই চলে যান। প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তারক্ষী আমান বলেন, হরতাল-অবরোধের দিন কোনো ছাত্রছাত্রী আসে না। শুক্রবার-শনিবার খোলা থাকলেও ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা আসে না। তাই স্যাররা
হাজিরা দিয়েই চলে যান। এতে অভিভাবকরা খুবই ক্ষুব্ধ। তারা প্রায়ই এসে অভিযোগ করেন। গত দুই মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ক্লাস হচ্ছে না। এতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

জানা গেছে, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকের বাড়িটি হলো সাবেক এমপি আলহাজ কাশেম আলীর। এর পরের বাড়িটি সাবেক সেনা কর্মকর্তার।  ৮৬ নম্বর সড়কের একেবারে দক্ষিণের বাড়িটি হলো পার্ক অ্যাভিলা (৭-বি) নামের একটি অ্যাপার্টমেন্ট। এতে বসবাস করেন ৩৪টি পরিবার। কার্যালয়ের উত্তরদিকের বাড়িটি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাড়িটি সিলগালা করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি বাড়িটি ভেঙে ফেলেন। বর্তমানে চার দেয়ালঘেরা ওই বাড়িটি কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষী সার্বক্ষণিক পাহারা দেন।

 

কার্যালয়ের উত্তর-পূর্বদিকের গলিটি ৮৮ নম্বর সড়ক। কার্যালয়ের পূর্বদিকের বাড়িটি একটি তেল-গ্যাস কোম্পানির অফিস। এর উল্টো দিকের বাড়িটি হলো থাই দূতাবাসের ভিসা প্রসেসিং কার্যালয়। প্রতিদিনই শতাধিক মানুষ নিরাপত্তার বিড়ম্বনা পেরিয়ে দূতাবাসে আসেন। কার্যালয়ের পশ্চিমদিকে রয়েছে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ওই প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনা করে।

কার্যালয়ের ঠিক পশ্চিমদিকে গুলশান সাহাবউদ্দীন পার্কের অবস্থান। ওই পার্কে সকাল-বিকাল শরীরচর্চা করেন অভিজাত এলাকার বসবাসরত বিভিন্ন দেশের বিদেশী নাগরিকসহ নানা পেশার মানুষ। ৮৬ নম্বর সড়কে কড়াকড়ির কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। পূর্বদিকের প্রবেশপথ বন্ধ থাকার কারণে প্রায় সময়ই অনেক পথ ঘুরে তাদের পার্কে ঢুকতে হয়।


খালেদা জিয়ার মতো কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ওই সড়কের বাসিন্দারাও। প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। নতুন নতুন হয়রানির মুখোমুখি হতে হয় তাদের। সকাল-বিকাল পড়তে হয় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সামনে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে বাসা থেকে ঢুকতে কিংবা বের হতে হয়। এমনটা যে হতে পারে তা তাদের চিন্তাতেও ছিল না কোনোদিন।

 

নিউজবাংলাদেশ.কম/আরআর/এফই

নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়