পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ
ফাইল ছবি
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে দলটি।
গণহত্যার অভিযোগে মামলা-গ্রেফতার ও সাধারণ জনগণের ক্ষোভের কারণে দৃশ্যত দলটির কোনো কার্যক্রম নেই। এমতাবস্থায় নানা ইস্যুতে দলটি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুটা কার্যক্রম চোখে পড়লেও তার রেশ নেই বাস্তবে।
আওয়ামী লীগের এমন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের জন্য বাস্তবতা প্রতিকূল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি গত ৫ই অগাস্টের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো দাবিও উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। যদিও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আবার এর বিরোধিতাও করেছে। তবে আদালতে জুলাই গণহত্যার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারিকভাবেই নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে আওয়ামী লীগের। ফলে তেমন পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মতো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ।
দলটি মনে করছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় ‘জনরোষ এখন সময়ের ব্যাপার’। ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামার পর সেখানে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী আওয়ামী লীগ। যদিও রাজনীতির জটিল সমীকরণ যে এতো সরলভাবে মিলে যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
তবে ভিন্ন কথা জানান দিচ্ছে তৃণমূলের চিত্র।
বিবিসি আরও জানায়, তৃণমূলের নেতারা দলের নির্দেশনা নিয়ে অন্ধকারে আছেন। তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন দলের দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য নেতাদের উপর। তাদের দাবি, এইসব নেতাদের জন্যই দলের এ অবস্থা।
এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করে তোলা উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলটির সব স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসতে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলছেন, অচিরেই দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেয়া হবে। ‘ধাপে ধাপে কর্মসূচিতে হরতালের কথাও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।’ কিন্তু তৃণমূলে যে দুর্বল অবস্থা সেখানে দলকে চাঙা করা চ্যালেঞ্জ হবে বলেই অনেকে মনে করেন।
এ বিষয়ে বিবিসিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও সেটা দলের কার্যক্রমে বাধার কারণ হবে না। কিন্তু নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই যখন তৃণমূলে ক্ষোভ তখন সেটা নিয়ে কী ভাবছে দল? এমন প্রশ্নে দলে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের ভিতরে যারা খারাপ আছে, গণধিকৃত যারা, যাদের দেশের জন্য কাজ করার যোগ্যতা নেই, তাদেরকে তো স্বাভাবিকভাবেই বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে হবে। যেখানে আওয়ামী লীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, সেগুলো আলোচনা করে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই দলীয় সভানেত্রীর নেতৃত্বে আমরা সংশোধন করব, সংযোজন করব, প্রয়োজনে বিয়োজন করা হবে।
বাহাউদ্দিন নাসিম আরও বলেন, উপজেলা-জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগ করেছেন, কথা বলেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন।
তৃণমূলে কী অবস্থা আওয়ামী লীগের?
তবে মাঠের চিত্র ভিন্ন, আওয়ামী লীগের একটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা তোরাব আলী (ছদ্মনাম) জানান, গত ৫ অগাস্টের পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিশেষত রাতে বাসায় থাকেন না।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তার সঙ্গে কথা হয়।
আলী বলেন, দলের কোনও খোঁজখবরই তার কাছে নেই। সবাইতো আছি দৌড়ের উপরে। দলের কাজ-কাম নিয়া আমাগো কোনও পরিকল্পনা নাই। নিউট্রাল অবস্থায় আছি। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ হয় না আর কেউ নাইও।
তৃণমূলের এই নেতা দলের নির্দেশনা নিয়ে অন্ধকারে আছেন। তবে তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন তার ভাষায় 'নিজ দলের কিছু দুর্নীতিবাজ নেতাদের' উপর।
তিনি বলছেন, খারাপ লোকদের দল থেকে ‘বের করতে হবে’। যে নির্যাতন এখন আমরা হইতেছি, এটা নিয়া ভাই বহু দুঃখ মনের মধ্যে। অনেক সময় সারাদিন চোখের পানি ফেলি। মনে মনে ভাবি দুর্নীতিবাজ নেতা যারা অন্যায় করছে, তাগো জন্য এখন পলায়া থাকতে হয়, জেল খাটতে হয়, রাইতে বাগানে থাইকা মশার কামড় খাইতে হয়, মামলা খাইতে হয়। কিন্তু কেন আমি এইসব ভোগ করুম?
যারা দুর্নীতি করছে, ওদের জন্যে আমার অশান্তি। ওরা যদি দলের ভেতর থাকে, তাইলে আমরা আর এর মধ্যে মাথা ঘামামু না। দলের পরিশুদ্ধ করা লাগবো, ম্যান বদলানো লাগবো।
এই ব্যক্তি এমনকি রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন। তবে সবাই যে এমন অবস্থায় আছেন তা নয়। ক্ষোভ থাকলেও সাংগঠনিক নির্দেশনার অপেক্ষাতেও আছেন অনেকে।
তাদেরই একজন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের নেতা এরশাদুল বারী (ছদ্মনাম)।
এরশাদুল বারী বলেন, উনারা (দলের শীর্ষ নেতারা) যে আমাদের কোনও দিক-নির্দেশনা না দিয়ে চলে গেল এবং এর পরে প্রায় চার/পাঁচ মাস কোনও খোঁজ-খবর রাখে নাই। অথচ উনারা সেইফ জোনে আছে। এটা আমাদের কর্মীদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি করেছে। কিন্তু এখন আবার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন অনেকেই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
কিন্তু কী করতে হবে সে বিষয়ে দলীয় কোনও নির্দেশনা কি পেয়েছেন এমন প্রশ্নে নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন বারী।
নির্দেশনা হচ্ছে আগে নিজেকে সেইফ রাখতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে এবং ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমাদের অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি আমাকে ফোন করেছিলেন। এটাই বলেছেন তিনি। এরপর জানতে পেরেছি অচিরেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আপা বক্তব্য দেবেন, ভার্চুয়াল মিটিং হবে। সেখানে আমাদের জুমে কানেক্ট হতে বলেছেন। সেখানে আপা (শেখ হাসিনা) যে নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে কাজ করতে হবে।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এখন দেখার বিষয় আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি