হাসিনা থেকে সুক ইওল: ফিরে দেখা ২০২৪
বাঁ থেকে- শেখ হাসিনা ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। ফাইল ফটো
স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার হরণ করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্রমাগত দমন-নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখার ইতিহাসও পুরনো। তবে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার সরকার প্রধানের পলায়নের পথ ধরে তার দোসররাও দলে দলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন এমন নজির শুধু বাংলাদেশ নয় তামাম পৃথিবীতেই বিরল। সরকারের পতনের পর কোন দেশের সরকার প্রধানসহ একসাথে কয়েকশ সংসদ সদস্য পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিস্ময়কর।
শুধু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই নন, যারাই গত ১৬ বছর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন, এমন ব্যক্তি মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে মন্দিরের পুরোহিত- কেউই নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। এমন বিরল ঘটনার সাক্ষী এখন পুরো বিশ্ববাসী। ২০২৪ সালে এর চেয়ে আলোচিত ঘটনা আর কি হতে পারে?
অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ। মাত্র আড়াই সপ্তাহে ছাত্র-জনতার উদ্বেলিত উৎসাহে রক্ত-কালি দিয়ে ঢাকা এবং সারা দেশের রাজপথে নতুন এক ইতিহাস লেখা হলো। এ ঘটনাকে জুলাই বিপ্লব, অভ্যুত্থান, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন- যে নামেই ডাকুন- মোটা দাগে এর একই মানে- তা হলো, দীর্ঘ ১৬ বছর দেশের আপামর জনগণের বুকের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে থাকা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন।
এই পতন কতোটা জরুরি ছিল তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানতে হয় না। আন্দোলনের সামনে থাকা ছাত্র-জনতার মুখ ও তাদের অভিব্যক্তিই প্রমাণ করে- স্বৈরাচারের পতন ব্যতিত আর কোনো দ্বিতীয় আকাঙ্খা তাদের ছিল না। তা না হলে- পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী সশস্ত্র বাহীনির অস্ত্রের মুখেও এই নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র-জনতা রাজপথ ছেড়ে পালায়নি। পরবর্তীতে যা একজন পুলিশ কর্মকর্তা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালকে বলছিলেন- ‘স্যার, গুলি করে মারার পরও এদের সরানো যাচ্ছে না, এটাই আসল সমস্যা’।
মৃত্যুর মুখে অবিচল থাকার এই মূলমন্ত্রের কারণেই ওই সময়ের ক’দিন আগে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’বলে বাঘের মতো যে আস্ফালন উচ্চারিত হয়েছে গণভবনে, ৫ আগস্ট মাত্র ৪৫ মিনিটের প্রস্তুতিতে সেই বাঘ মুহূর্তে বিড়ালে পরিণত হয়ে প্রমাণ করেছে জনগণের চেয়ে বড় কোনো বাঘ এই দেশে নেই।
দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার হঠাৎ কেন এই পরিনতি হলো?
এর উত্তর যে কোনো পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিশুটিও এখন জানে। এর কারণ- গত ১৫ বছর ধরে মানুষের ভোট দিতে না পারা, বিরোধী মত দমন করতে হত্যা, গুম, আর নির্বিচার মামলায় নেতা কর্মী- বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে জেলে পুরে রাখা, হুমকি আর ভয়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এর বিরুদ্ধে সকল মানুষের পূঞ্জিভূত ক্ষোভ উথলে ওঠেছে ছাত্র-জনতার বুক থেকে। যার কারণে কোনো বাধাই তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
একটু পেছনে গেলে- ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে পরিপত্র ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। প্রতিবাদে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। ৯ জুন দাবি মানতে ৩০জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন তারা। ১ জুলাই ছাত্র সমাবেশ থেকে চূড়ান্ত সুরাহার জন্য আবারও ৪জুলাই পর্যন্ত আল্টিমেটাম শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি ৩দিনের কর্মসূচিও দেয়া হয় সমাবেশ থেকে।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক মন্ত্রীর একগুয়েমি, খামখেয়ালীপনা আর শিক্ষার্থীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেয়া হাসিনার বক্তব্য আগুনে ঘিঁ ঢালে।
জুলাই গণঅভ্যুথ্থানে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে জনতার ঢল। ছবি: সংগৃহীত
১৪ জুলাই চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর "রাজাকারের বাচ্চা" শীর্ষক বক্তব্য আন্দোলনের গতি তীব্র করে তোলে। এরপর "তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার" স্লোগানে উত্তাল হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্বিদ্যালয়, বোগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ জুলাই "রাজাকার" শ্লোগানের জবাব দিতে ছাত্রলীগকে উস্কে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এরপর আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ।
১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ওয়াসিম, শান্ত, ফারুক এবং ঢাকায় সবুজ আলী ও শাহজাহান নিহত হন। ১৭ জুলাই আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। ১৮জুলাই পূর্ব ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে মুগ্ধ-ফাইয়াজসহ ৪৮জন শহীদ হন।
এরপর অগ্নিগর্ভে পরিণত হয় বাংলাদেশ। ১৯ জুলাই পুলিশ ও বিজিবির নৃশংস গুলিতে মারা যান আরো ১১৯ জন। হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণে বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় ৬ বছরের রিয়া গোপ। এরপর দেশজুড়ে জারি করা হয় কারফিউ। কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতার মিছিলে ২০জুলাই শহীদ হন আরও ৭১ জন।
দিন যতো গড়াতে থাকে মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকে। একই সাথে চলে গণগ্রেফতার। ২৮ জুলাই ১০ দিন পর সচল হয় ইন্টারনেট। গণহত্যার বিচার চেয়ে ফেসবুক প্রোফাইল রক্তিম হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীসহ সাধারণ মানুষের।
২ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ৯ দফা বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র সমন্বয়করা। এরপর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে থাকে। ৪ আগস্ট বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এ দিনেও ১৩০ জন শাহাদাত বরণ করেন। ৬ আগস্টের বদলে ঢাকা মুখী লং মার্চ একদিন এগিয়ে আনেন শিক্ষার্থীরা।
৫ আগস্টেও সকাল থেকে সতর্ক অবস্থান নেয় পুলিশ, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী। কিন্ত শেষ রক্ষা হয়নি শেখ হাসিনার। মানুষের সব ক্ষোভ উগড়ে পড়ে গণভবন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ।
রিপাবলিকানদের কাছে পরাজিত ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডিন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলাপরত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: ইন্টারনেট
তো গেল বাংলাদেশ থেকে হাসিনার পলায়ন পর্ব। এবার ফিরে দেখা যাক ২০২৪ সালের বৈশ্বিক শাসকদের দিকে। ২০২৪ যতোটা না যুদ্ধ-সংঘাতের বছর; তার তুলনায় বেশি নির্বাচনের। বিশ্বের কমপক্ষে ৬০টি দেশে এ বছর হয়েছে নির্বাচন। বেশিরভাগ দেশেই ক্ষমতাসীনদের মেনে নিতে হয়েছে পরাজয়। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থিদের হারিয়ে উত্থান হয়েছে বাম ও মধ্যপন্থিদের। নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতাবদলের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে সিরিয়ার মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণও। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি, গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে হতাশা আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই দেখা গেছে চলতি বছরের নির্বাচনগুলোয়।
বছরের অন্যতম আলোচিত নির্বাচন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের হারিয়ে জয়ী হয়েছে রিপাবলিকানরা। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। পর পর তৃতীয় বারের মতো এবছর ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় হলো মার্কিন নির্বাচনে। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে তার দলের ঠিকই পরাজয় হয়েছে।
কেন এই ভরাডুবি? পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, চলতি বছর ক্ষমতাসীন দলগুলোর ভরাডুবির মূল কারণ- অর্থনৈতিক মন্দা। তাছাড়া, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে হতাশাও ছিল আরেকটি বড় কারণ।
যুক্তরাজ্যেও ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে জয়ী হয় বামপন্থি লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে নাটকীয় পরাজয় বলা যেতে পারে বতসোয়ানার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পরাজয়কে। প্রায় ৬০ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় ছিল বতসোয়ানা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।
ভারতে চলতি বছর পর পর তিন মেয়াদের মতো ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। জোট সরকার গঠন করতে হয়েছে মোদিকে।
জাপানেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি সময় দেশ শাসন করা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি।
ব্যতিক্রম হিসেবে ২০২৪ এর নির্বাচনে ইতিহাস গড়েছে মেক্সিকো। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কোনো নারী। প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন ক্ষমতাসীন মরেনা পার্টির প্রার্থী ক্লডিয়া শেইনবাউম।
মেক্সিকোর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউম। ছবি: ইন্টারনেট
ইউরোপের নির্বাচনেও লক্ষ্য করা গেছে আদর্শগত পরিবতন। ফ্রান্স, গ্রিস, স্লোভেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বামপন্থিদের বেছে নিয়েছেন দেশগুলোর জনগণ। অবশ্য, চলতি বছর জুনে আগাম ভোটের আয়োজনের পর থেকেই অস্থিরতা চলছে ফ্রান্সে। সম্প্রতি বিশেষ ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর বাজেট পাশকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ওঠে প্রেসিডেন্ট ম্যাকরনের পদত্যাগের দাবিও।
নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের বাইরেও ২০২৪ জুড়ে বিভিন্ন দেশে ঘটেছে ব্যতিক্রমও। চলতি বছরের মে-তে বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির আকস্মিক মৃত্যুতে নির্ধারিত সময়ের আগেই হয় নির্বাচন। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন উদারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান।
বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন উদারপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান। ছবি: ইন্টারনেট
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সিরিয়ায় গেল নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বিদ্রোহীরা। তাদের অভিযানের মুখে মাত্র ১১ দিনের মাথায় দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ২ যুগের শাসক বাশার আল আসাদ।
বছর শেষে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতেও দেখা দিয়েছে জটিলতা। ডিসেম্বরের শুরুতে আকস্মিক সামরিক আইন জারি করে অভিশংসিত হন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। তার বিরুদ্ধে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও, আদালতে চলছে যার বিচার। গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আসাদুল হক খোকন: নিউজ এডিটর, নিউজবাংলাদেশ.কম
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি