ঘোষণা দিয়ে লাপাত্তা নব্বইয়ের লড়াকুরা
ঢাকা: নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা। তাদের লাগাতার আন্দোলনে এরশাদ সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এবারও নব্বইয়ের মতো বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও হাসিনা সরকারকে বিদায় করার ঘোষণা দেন সেই লড়াকু ছাত্র নেতারা।
কিন্তু তাদের ঘোষণাই সার। আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে সবখানেই অনুপস্থিত সেই লড়াকুরা। আর এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের অন্ত নেই। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন সংবাদ সম্মেলনে এসব নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় হবার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তৎকালীন ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে ছাত্র কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই কনভেনশনেও প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ৯ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্র কনভেনশনের ঘোষণা করেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা ও ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আমানউল্লাহ আমান। উদ্দ্যেশ্য ছিল, নব্বইয়ের ছাত্র কনভেশনের আদলে আবারও কনভেনশন করে সাবেক ও নতুন ছাত্রনেতাদের উদ্যম বাড়ানো।
১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বহুব্যয়ে সাজসজ্জা করে দিনভর আলোচনা সভা করে সেই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও প্রধান অতিথি ছিলেন খালেদা জিয়া। কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ও বর্তমানে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব আমানউল্লাহ আমান। তৎকালীন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকন কনভেনশন পরিচলনা করেন। কনভেনশনে সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে শামসুজ্জামান দুদু, ফজলুর রহমান মিলন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান বাবুল, গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মণি, জাগপা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার লুৎফুর রহমান, আসাদুর রহমান খান আসাদ, নাজিমউদ্দিন আলম, কামরুজ্জামান রতন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, শিরিন সুলতানা হেলেন জেরিন খান, ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি রাজিব আহসান, সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দেড় শতাধিক নেতা বক্তব্য দেন।
এছাড়া ডাকসু, জাকসু, চকসু, রাকসুসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জেলা, থানা পর্যায়ের ছাত্র সংগঠনের ভিপি, জিএস, এজিএস এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ চার হাজার নেতাকর্মী এতে অংশ নেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সামনেই লড়াকু ছাত্রনেতারা অঙ্গীকার করেছিলেন, “এবার আর ছাত্রনেতারা ঘওে বসে থাকবে না। দেয়ালে পিট ঠেকে গেছে। নব্বইয়ে যেমন করে লড়াই করে এরশাদকে বিদায় করেছেন ঠিক তেমনি করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও বর্তমান সরকারকে বিদায় করব।”
ছাত্রনেতাদের প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বান ছিল, “তোমরা আরেকবার গর্জে ওঠো, নবীন-প্রবীণে মিলে তোমাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত সেই গণতন্ত্র আজ হরণ করা হয়েছে। সেই গণতন্ত্র আবার লড়াই করে ফিরিয়ে আনবে এটাই আমার চাওয়া। আমাদের বয়স হয়ে গেছে। তোমাদের এবারের লড়াইয়ে আমি নিজেও শরিক হব।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বয়স হয়েছে কিন্তু সাহস কমেনি।”
ছাত্রদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “২৫ বছর আগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম। তোমরা ছিলে তখন আমার শক্তি। আজ পুরনো মুখগুলো দেখে আমার ভালো লাগছে। কেবল স্লোগান, হাতে তালি আর কাউকে গালি দিলেই চলবে না, ডাক আসলে সবাইকে রাজপথে নেমে আসতে হবে। যেকোনো সময়ে আন্দোলনের ডাক দেব। টিয়ার গ্যাস, লাঠিপেটা ও পুলিশের গুলিকে উপেক্ষা করে ছাত্রসহ সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে। এই জালেম সরকারকে বিতাড়িত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
কিন্তু খালেদা জিয়ার আহ্বান এবং নিজেদের করা অঙ্গীকার সত্ত্বেও রাজপথে দেখা মেলেনি এইসব ছাত্র নেতাদের। দলের এই অতীব প্রয়োজনের সময়ে নিজ ঘর, বাণিজ্যালয় কোথাও নেই তারা। মোবাইল ফোনও বন্ধ। নেতাকর্মীদের সাথে নেই কোনো যোগাযোগ-এমন অভিযোগই করেছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে আরও বলেন, গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসে তিনি রাজপথে নামার জন্যই নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সরকারের সেই বালুর ট্রাক, পুলিশ আর গেটে তালা তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এ পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য তিনি অবরোধ ঘোষণা করেছেন। আজও তিনি অবরুদ্ধ। চেয়ারপারসনের গ্রেপ্তারি পরওয়ানা ও কার্যালয় তল্লাশি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন খালেদা জিয়া। এতো কিছুর পরও সেই নব্বইয়ের লড়াকুরা ‘এক পা’ এগিয়ে আসেননি। গত আন্দোলনে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ঘোষণার পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি। অথচ এরাই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। ”
আবার এসব নেতাদের মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরি, জাহাজ, যানবাহন, স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, জমির ব্যবসা সরকার দলীয়দের মতোই চলছে। নেতাকর্মীদের রক্তের বিনিময়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এসব সুবিধাবাদী আত্মগোপনে থাকা নেতারাই আবার মন্ত্রী এমপি হবেন-এমন অভিযোগ করেছেন পুলিশের
গুলির মুখে মাঠে থাকা নেতাকর্মীরা।
বিদ্রোহী দাবানল নামের এক ফেসবুক পেজ, যা বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের বলে পরিচিত, সেখানে দেয়া একটি স্ট্যাটাসে জানতে চাওয়া হয়, “কোথায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান? কোথায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে দুজন যুগ্ম মহাসচিব দলের হাল ধরে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাদের একজন রিজভি আহমদ ২৯ দিনের রিমান্ডে। অন্যজন সালাহ উদ্দিন আহমদ ইলিয়াস আলীর পথে গুম হওয়ার আশঙ্কায়। অথচ দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে আমান উল্লাহ আমান আর বুলুর অগ্রাধিকার
বেশি। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমান-বুলুর অগ্রাধিকার বেশি। কিন্তু আজকে দলের দুর্দিনে কোথায় সেই রাঘব বোয়াল আমান-বুলু? আসলে দোষ তো আমাদের তৃণমূল কর্মীদের। আমরা বার বার জোঁকে পরিণত হওয়া
নেতাদের পেছনে রাজনীতি করার কারণেই আজ তারা আমাদের মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছে। দলের হাইকমান্ড কখনোই তৃণমূলের সুবিধার কথা চিন্তা করেনি। বিএনপির হাইকমান্ড সবসময় এই আমান-বুলুর মত রাঘব বোয়ালদের মতামত, সুযোগ-সুবিধার অগ্রাধিকার দিয়েছে। গত আন্দোলনে এই রাঘব বোয়ালরা পলাতক থাকার পরও যখন আবার এদের মূল্যায়ন করা হয়, তখন কি আর আন্দোলন গাছে ধরে? দলের ভেতরে থেকে আপনারা দলের সাথে যে গাদ্দারি করছেন তা শেখ হাসিনার বাকশালি আচরণ থেকেও নির্লজ্জ, জঘন্য, মানবতাহীন নিষ্ঠুর কর্ম।”
এ বিষয়ে আলাপ করার জন্য নব্বইয়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ত তৎকালীন ছাত্রনেতা, বর্তমানে বিএনপিতে আছেন, তেমন কোনো নেতার খোঁজ পাওয়া যায়নি, সকলের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে খায়রুল কবির খোকনের স্ত্রী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “খোকন নরসিংদীতে আছে, যোগাযোগ হয়, তবে প্রতিদিন নয়। তার বিরুদ্ধেও অসংখ্য মামলা দেয়া হয়েছে। খোকন এলাকায় কাজ করছেন।”
ছাত্র কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন, ডেমক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মণি, যিনি ২০ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত, তার কাছে আন্দোলনে মাঠে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখুন, আমরা কনভেনশন করেছিলাম, আন্দোলনে রাজপথেও থাকতে চাই। নব্বইয়ের স্বৈরাচার সরকারের সময়ও আমরা রাস্তায় নামতে পারছি। কিন্তু এই সরকার তো আমাদেরকে রাস্তায় নামতে দিচ্ছে না। পাকিস্তানি বাহিনী যেমন দেখলে গুলি করত, তেমনি এই সরকার গুলি করছে গুম-খুন করছে। কোনো মিটিং মিছিল করতে দিচ্ছে না। আগে তো এমনটা ছিলো না। কোথাও সংগঠিত হতে পারছি না। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
কনভেশনে উপস্থিত নেতাদের মোবাইল বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার মোবাইল তো বন্ধ না। কারো কারোটা বন্ধ থাকতে পারে, এবিষয়ে তাদের উপর চাপ থাকতে পারে। আন্দোলনে নামা ও মোবাইল খোলা রাখার বিষয়ে মোবাইলে ফোন করে হুমকি দেয়া হচ্ছে, গুম করে ফেলা হবে। তাদের হয়তো এমন হুমকি দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এতোকিছুর পরও আন্দোলন সফল।”
জাগপার সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান নিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে চাই। কিন্তু সরকার সভা-সমাবেশের ওপর জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। দেখামাত্রই গুলি করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কি এটা হয়? শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিবেশ সৃস্টি হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো পরিবেশ সরকার রাখেনি।”
তিনি বলেন, “আমরা রাস্তায় নেমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করব। পুলিশ লাঠিপেটা করবে, করুক। রাস্তা থেকে গ্রেফতার করুক। কিন্তু এখন তো বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা ফেলা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে। পাকিস্তানি আমলেও এমনটা করা হয়নি। একটু ওয়েট করেন ভালো কিছু দেখতে পাবেন।”
নিউজবাংলাদেশ.কম/আরআর/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম