News Bangladesh

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৩:১৭, ৫ মার্চ ২০২১
আপডেট: ১৩:২২, ৫ মার্চ ২০২১

আমাদের গণতন্ত্র ও কিছু কথা

আমাদের গণতন্ত্র ও কিছু কথা

আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের নেতাকর্মী আছেন, যারা বিভিন্ন সভা সেমিনারে গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা নিজেরাই গণতন্ত্রের বিচার বিশ্লেষণে বিশ্বাস রাখেন না। তাদের সংজ্ঞা মতো যদি গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা কারো সাথে না মিলে, তাহলে দেখা যায় তাদের বক্তব্য তখন গণতন্ত্রের রীতিনীতির আশেপাশে না থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। তাদের কথাবার্তার মধ্যে এক ধরনের অন্যরকম অহমিকা ভাব বিরাজ করে। অর্থাৎ এই ধরনের গণতন্ত্রপ্রেমীরা অন্য রকম হয়ে যান। এই শ্রেণীর গণতন্ত্রীদের মুখে গণতন্ত্রের কথা থাকলেও তাদের চলাফেরা কিংবা তাদের বক্তব্য মিলে যায় চরম দক্ষিণপন্থিদের চলাফেরা ও বক্তব্যের সাথে। যারা নিজেরা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মতে চলেন না, তারা যখন গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এই ধরনের ব্যক্তিরা কোন ধরনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আস্থা রাখেন। তারা কি মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলেন, নাকি তাদের নিজস্ব গণতন্ত্রের কথা বলেন। মানুষের গণতন্ত্রের কথা যখন আসবে, তখন কিন্তু দেশ ও দশের উন্নয়নের কথাও আসবে। আবার যারা নিজেদের বক্তব্য অনুযায়ী গণতন্ত্রের কথা বলবেন, তাদের গণতন্ত্রের সাথে জনগণের মৌলিক কোনো সম্পর্ক থাকে বলে কেউ বিশ্বাস রাখেন না। কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা বিশ্বাস না রাখেন, তাহলে মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে তারা কেন গণতন্ত্রের জন্য এত কান্নাকাটি করেন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানতে হলে আমাদেরকে গণতন্ত্রের সর্বজনীন রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। 

গণতান্ত্রিক রীতিনীতির উপর তারাই শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, যারা গণতন্ত্রের মূল জায়গায় অবস্থান করে গণতন্ত্রের শোভন চর্চা করে থাকেন। গণতন্ত্রের মূল জায়গায় তারাই অবস্থান করতে পারে কিংবা গণতন্ত্রের শোভন চর্চা তারাই করতে পারে, যারা শোষিতের গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন। যারা গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেশের বৃহৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা করতে চান, তারা কিন্তু গণতন্ত্রের প্রকৃত জায়গায় যেতে চান না। যেসব লোকেরা দেশের দরিদ্র মানুষকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা করেন, সেই সব ব্যক্তি কিন্তু মানুষের অধিকার কিংবা মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন না। মানুষ বলতে এখানে দেশের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষদেরই বুঝানো হচ্ছে। গরিবের  গণতন্ত্র যদি কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সেই সমাজের মানুষ কোনো দিন সুখের মুখ দেখতে পায় না। ধনীর গণতন্ত্রে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কোনো উন্নতি হয় না এবং যে দেশের সমাজে বিত্তবান ব্যক্তিদের গণতন্ত্র চর্চা হয়, সেই দেশের মানুষ সকল সময় অর্থনৈতিক দূরবস্থার মধ্যে বসবাস করে থাকে। এ কথা সবাই বিশ্বাস করবেন, যে সমাজ এবং রাষ্ট্রে শুধু মাত্র ধনিকশ্রেনীর গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চা করা হয়, সেই সমাজ এবং রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠী সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে বাঁচার জন্য লড়াই করতে থাকে। ধনিক শ্রেণীর গণতন্ত্রের কুপ্রভাবে বঞ্চিত হতে হতে মানুষের মনে অনেক দুঃখ এবং বেদনায় প্রশ্ন আসতেই পারে, গণতন্ত্রে কি মানুষের পেট ভরে। আমাদের চোখের সামনে আজ দেখতে পাই একশ্রেণির লোক গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার করেন ঠিকই। কিন্তু বাস্তবে তারা কোন গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার করছেন, তা তারা দেশের মানুষকে বুঝাতে পারছেন না কিংবা ইচ্ছে করেই হয়তোবা বুঝাতে চাইছেন না। তারা জানেন দেশের মানুষ যে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে চায়, তারা সেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর শ্রদ্ধাশীল নন। তারা আন্দোলনের কথা বলেন। কিন্তু সেই আন্দোলনের রূপ রেখায় মানুষের কথা থাকে না। তারা শুধু ক্ষমতার রত বদলের কথাই বলে। অর্থাৎ ব্যক্তির বদলে ব্যক্তিকেই ক্ষমতায় বসাতে চান। তাই মানুষ তাদের পিছনে এসে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে না।

অনেকেই প্রশ্ন করেন গণতন্ত্র আর উন্নয়ন কি এক সাথে চলতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা নেতিবাচক ব্যক্তিদের কাছে জানতে চাই, তাহলে তারা বলবেন গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন এক সাথে তখনই চলতে পারে, যখন ড্রেনের মুখ বন্ধ রেখে ড্রেন পরিষ্কার করা যায়। আবার ইতিবাচক ব্যক্তিদের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, গণতন্ত্র আর উন্নয়ন কি এক সাথে চলতে পারে? তাহলে ইতিবাচক ব্যক্তিরা বলবেন, গণতন্ত্র যেমন দেশের মানুষের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি করে উন্নয়নও দেশের মানুষের স্বার্থেই করা হয়ে থাকে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য গণতন্ত্র যেমন প্রতিষ্ঠিত সত্য, ঠিক তেমনি করে একটি দেশের উন্নয়ন হচ্ছে দেশের মানুষের কাছে খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। গণতন্ত্র একটি দেশের মধ্যে তখনই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে, যখন সেই দেশের জনগণ অভাব অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে দুবেলা পেট ভরে খেতে পারে। একটি উলঙ্গ মানুষ গলায় হীরার চেইন পরে যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে কিছুতেই সুন্দর দেখায় না। তেমনি করে শোষিতের গণতন্ত্রহীন একটি দেশের মধ্যে হীনস্বার্থ উদ্ধারকারী অসুশীল ব্যক্তিদের বড় বড় কথা বলা কিংবা জনগণকে সুবোধ বালক ভেবে জ্ঞান দেয়া মানায় না। আমাদের দেশের মধ্যে একশ্রেণির মাথামোটা  অশ্লীল অসুশীল ব্যক্তিরা আছেন, যারা সকল সময় খুঁজে বেড়ান রুটির কোন পিঠে মাখন লাগানো আছে। এই অসুশীল ব্যক্তিরা মাখনের খোঁজ করতে গিয়ে কখন যে অগণতান্ত্রিক মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিদের ডান হাত হয়ে যান, তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারেন না। এই শ্রেণির রুটির পিঠের মাখনের পিছনে দৌঁড়ানো ব্যক্তিদের অসামাজিক কথাবার্তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত কিংবা মাঝ পথে থমকে দাঁড়ায়। যা আমরা দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী দেশের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ প্রথম দিকে দেখতে পেয়েছি। এই অসুশীলদের কর্মকাণ্ড কিন্তু এখনো থেমে নেই। তারা মুখে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে। কিন্তু দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেশের এই শ্রেণির অসুশীল বুদ্ধিজীবীদের কোনো নীতি আদর্শ নেই। তারা মুখে মুখে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বলে চিৎকার করে। আবার দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বঙ্গবন্ধুর সমালোচনাকারী চরম দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের সাথে তাদের খুব মধুর সম্পর্ক। এসব মাস্কধারী বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যখন চরম দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিদের নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, তখন আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে দেশের প্রগতির মাস্ক পরা জনগণের পরম শত্রু বুদ্ধিজীবীরা কিংবা দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দেয়ার জন্য গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে মায়াকান্না করছেন। তারা মূলত জনগণের গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন না। তারা সেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন, যে গণতন্ত্র প্রতিষ্টিত হলে তাদের হীনস্বার্থ উদ্বার হবে। গণতন্ত্র ও প্রগতির মাস্ক পরা দেশের অসুশীল বুদ্ধিজীবীরা কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ বলেন। নজরুলের কবিতা পাঠ করেন। কিন্তু বাস্তবে তারা রাবীন্দ্রিক কিংবা বিদ্রোহী কবি নজরুলের মানবতার দর্শনে বিশ্বাস রাখেন না। লাল পতাকা দিয়ে সমাজতন্ত্রী সেজে যেমন লাল পতাকাকে অর্থাৎ সমাজতন্ত্রকে সমাজতন্ত্রী বিরোধীরা আটকাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে, তেমনি করে আজ দেশের মধ্যে একশ্রেণির রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কিংবা অসুশীল মাথামোটা রুটির পিঠের মাখানের পেছনে দৌড়াতে থাকা এবং নিজেদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে দাবি করা ব্যক্তিরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করে আমাদের দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে তৎপর হয়ে উঠছে। নেতিবাচক অসুশীল ব্যক্তিরা এবং দক্ষিণপন্থী রাজণৈতিক দলের নেতারা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমূহ চোখে দেখতে পায় না। তাদের মুখে শুধু এক কথা ‘গণতন্ত্র নেই গণতন্ত্র নেই’। তারা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। আবার দেখা যায় তারাই আবার বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশের সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হলে বলে কারচুপি হয়েছে। আবার নির্বাচনে জয়ী হলে বলে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। তাদের ভাবখানা এমন তাদের পক্ষে যতক্ষণ সবকিছু থাকবে, ততক্ষণ সব যেন ঠিকঠাক চলবে। আবার তাদের মনমতো কিছু না হলেই চিৎকার শুরু করবে ‘গণতন্ত্র গেল গণতন্ত্র গেল’ বলে। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মানুষ যেমন সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়, তেমনি করে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও অনেক সময় মাঝ পথে থমকে দাঁড়ায়। আর তাদের অর্থাৎ দক্ষিণপন্থীদের দেশ বিরোধী কার্যকলাপে সহযোগিতা করে থাকে প্রগতির মাস্ক পরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করা অসুশীল ব্যক্তিরা। দেশের জনগণ নেতিবাচক ব্যক্তিদের কার্যকলাপ দেখে মনে করে যে, তাহলে কি গণতন্ত্রে পেট ভরে না। মূলত অগণতান্ত্রিক দক্ষিনপন্থী ও গণতন্ত্র বিরোধী ব্যাক্তিদের কর্মকান্ডের জন্যই আজ দেশের মাঝে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার অগণতান্ত্রিক দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের এবং হীনস্বার্থ উদ্ধারকারী অসুশীল বুদ্ধিজীবীদের সমলোচনায় কান না দিয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। 

তাই বলছিলাম, বর্তমান সরকারের উচিত হবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়া। কেননা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, গণতন্ত্রের বিকাশমান ধারা আরো বেশি করে বিকশিত হচ্ছে। পেটে যদি ভাত না থাকে, তাহলে আমরা কি ধনিক শ্রেণির গণতন্ত্র খেয়ে বাঁচব?

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল: আইনজীবী, কবি, গল্পকার। 

নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়