সড়ক দুর্ঘটনার নামে এই ‘গণহত্যা’ আর কতদিন?
মাত্র ৫ মাস আগেই স্বপ্ন কিনে ঘরে এনেছিলেন একাত্তর টিভির ভিডিও এডিটর গোপাল সুত্রধর। আর সেই স্বপ্ন পূরনই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য।
একটা মোটরসাইকেলের বড্ড শখ ছিলো তার। কিন্তু কোনোভাবেই সেই স্বপ্ন পূরণ করার সামর্থ্য হচ্ছিলো না। পাঁচ মাস আগে যখন সেই স্বপ্ন পূরন করে ফেললেন তখন তার আনন্দের কমতিও ছিল না। কিন্তু সেই আনন্দই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে কে জানতো।
বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বেপরোয়া গতির একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন গোপাল চন্দ্র সুত্রধর।
চলে গেলেন গোপাল, ফেলে গেলেন তার স্বপ্ন। মোটরসাইকেল কিনে ফেসবুকে নিজের স্বপ্ন পূরনের আনন্দবার্তা জানান দিয়েছিলেন গোপাল। তিনি লিখেছিলেন, "পূর্বের সাত বছর পাগল ছিলাম একটা বাইক কেনার জন্য এবং পরবর্তী চার বছর এমন কোন দিন নাই যে আমি একটা দিনের জন্যও বাদ দিয়েছি বাইকের রিভিও দেখা। দিনে তিন চার বার পুরাতন বাইকের ইউটিউব দেখতাম। মার্কেটে কোন বাইকটার কত দাম কি ফিচার আমার মুখস্থ। বিক্রয় ডট কম থেকে শুরু করে যত প্রকার অনলাইন সাইট আছে সবসময় বাইকের পোস্ট দেখেছি । রাস্তায় বাইক দেখলেই তাকিয়ে থেকেছি। কিন্তু খুবই নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাইক কেনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। স্বপ্নটা আমার জন্য মোটামুটি অবাস্তবই ছিল। কিন্ত না। ইভ্যালি আমার সেই স্বপ্নকে আর অবাস্তবে থাকতে দিল না। সাথে ছিল আমার কয়েকজন স্বপ্নসারথি বন্ধু।
যারা আসলে নামের জন্য নয় ভালবেসে আমাকে স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করেছে। যাই হোক আজ আমার স্বপ্ন আমার দরজায়। ভালবাসি বন্ধু। ভালবাসি ইভ্যালি।"
তার অনেক বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীরা তখন তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই একই আনন্দ বার্তায় যে বিদায় বার্তাও জানাতে হবে তা হয়তো কেউই ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি।
রহিম রুমন নামে একজন লিখেছেন, 'এই স্বপ্ন পূরণ না হলে আজ হয়তো আপনাকে হারাতে হত না আমাদের।'
জামাল মোস্তফা লিখেছেন, 'বিদায় গোপাল।'
আরেফিন শাকিল লিখেছেন, 'বিদায় দাদা। বাইক আপনার জীবনটা নিয়ে গেলো।'
গোপাল সুত্রধরের ফেসবুক ওয়াল এখন বিষাদময়। এই হাস্যোজ্জল মানুষটা আর কোনো মন্তব্যের উত্তর দিবেন না। এই স্বপ্নবাজ মানুষটা আর কোনো স্বপ্ন দেখবেন না। আর ছুটে বেড়াবেন না ঢাকার পথে প্রান্তরে।
মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়। কিন্তু স্বপ্নও কখনো কখনো কাল হয়ে দাঁড়ায়। অসতর্কতা, বেপরোয়া গতি, বাসচালকদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্মে গোপাল সুত্রধরের মত অনেককেই অকালে হারিয়েছি আমরা। তারা চলে গেছেন, ফেলে গেছেন তাদের স্বপ্ন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব। আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন একরাশ বিষাদ আর ধিক্কার।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। আর আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি। বিদায়ী ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত এবং ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন।
ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। মাকে দেখতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় লাশ হলেন সন্তান। বিয়ের প্যান্ডেলে পড়ানো হলো সড়কে নিহত বরের জানাযা। বাংলাদেশের সড়কে এমন সব করুণ কঠিন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন। এই ট্র্যাজেডির বার্ষিক পরিসংখ্যান হলো প্রায় আট হাজার মৃত্যু।
চেষ্টা করলে, যথাযথ ব্যবস্থা নিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার নামে এই ‘গণহত্যা’ কি কোনোভাবেই বন্ধ করা যায় না? নয়তো আজকে গোপাল, কালকে আমি, পরশু আপনি এভাবে প্রতিদিনই কেউ না কেউ চলে যাবে। আর আমরা কেবল দেখবো, দেখেই যাব!!
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস