নারী-বিদ্বেষ জিইয়ে রেখে শাস্তিতে কী হবে?
আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, আমার আছে। বেশ ছোট আমি তখন, স্কুলে পড়ি। পড়তে লিখতে জানি।
ডাক্তার মায়ের পুত্র মুনির, তার গর্ভবতী স্ত্রী, সাংবাদিক বাবার কন্যা, রীমাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় খবর আসে, আলোড়ন চলে সর্বত্র।
ম্যাগাজিনের পাতা থেকে, বড়দের আলাপ থেকে, হত্যাকারী মুনিরের পরকীয়া প্রেম সম্পর্কেও জানতে পারি। কিছু কিছু বিষয় বুঝতেও পারি। কয়েক বছর পর মুনিরের বিচার হয়, তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
আমার নানী সারা খাতুন এই ফাঁসির সংবাদ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “আহা, ছেলেটার মায়ের বুক খালি হয়ে গেল।”
ততদিনে বেশ খানিকটা বড় হয়েছি। ফোঁস করে বললাম, “আর ও যে মেয়েটাকে খুন করল, তার মা কি মা না?”
নানী বললেন, “ওর যা হওয়ার হইছে, ছেলেটারে ফাঁসি দিলে কি মেয়েটা ফিরা আসবে?”
তারপর মনে হয় ‘হাশরের দিন আল্লাহ বিচার করবেন’ ইত্যাদি বলেছিলেন তিনি। আমি ওই বয়সেই আমার মাতামহীর মধ্যে ধর্মের প্রতি অগাধ আনুগত্য আর সমাজের প্রতি সমীহটা বুঝতাম।
আমার নানী ছিলেন স্নেহের আধার। অনেকটা ম্যাক্সিম গোর্কির দিদিমার মত। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন। সবার জন্য অবিশ্রাম পরিশ্রম করতেন। কিন্তু ওইযে বললাম, সমাজের প্রতি সমীহ, নাতনিদের তুলনায় নাতিদের প্রতি তার আলাদা পক্ষপাতিত্বও ছিল। ওই বয়সে বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট অভিমান কাজ করত।
ফলে, তার কথাকে পাত্তা দেইনি। বেয়াদবি হবে ভেবে তর্ক করিনি, মেনেও নিইনি। তার অন্ধত্বটাই দেখেছি।
আজ ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ ফিল্মটা দেখে নানীর কথাগুলো মনে পড়ল।
জ্যোতি সম্পর্কে একটা গল্প শোনা গেল ফিল্মটিতে।
একটা বারো তেরো বছরের ছেলে একবার জ্যোতির ব্যাগ টেনে নিয়ে দৌড়ে পালায়। লোকজন বাচ্চাটাকে ধরে মারলে, পুলিশের কাছে দিতে চাইলে জ্যোতি তাকে বাঁচায়। বলে- “এভাবে বাচ্চারা কিছু শেখে না।”
ছেলেটাকে আলাদা ডেকে নিয়ে সে বলে- “এরকম কর কেন?”
ছেলেটা বলে- “আমারও আপনাদের মত ভালো কাপড়, জুতা পরতে ইচ্ছা করে। আমারও বার্গার খেতে ইচ্ছা করে।”
জ্যোতি তাকে এ সমস্ত কিনে দেয়, প্রতিজ্ঞা করায় সে আর চুরি ছিনতাই করবে না।
ফিল্মটা যারা দেখেছেন গল্পটা তাদের জানা। তবু বললাম। লক্ষ্মীমন্ত জ্যোতি নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব করেছে। বলা বাহুল্য, ওর এই পদক্ষেপ ছিল আবেগপ্রসূত।
যে বৈষম্যের সমাজ বারো বছরের ছেলেকে ছিনতাইকারী বানায়, সে সমাজই সতের বছরের ছেলেকে ধর্ষক বানায়। যেখানে দারিদ্র নেই, সেখানেও ধর্ষকরা আছে। থাকবেই।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক আদতে ক্ষমতার সম্পর্ক। ধর্ষণের গল্প আদতে ক্ষমতার অসম বণ্টনের গল্প। ধর্ষণের সংস্কৃতি জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার মতই রাজনৈতিক।
জ্যোতির ঘটনা শোনার পর থেকে যতবার ওর কথা ভেবেছি শিউরে উঠেছি, যোনিতে লোহার শিক ঢুকিয়ে দেয়ার পরও, যোনিপথে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়ার পরও, বেঁচে ছিল মেয়েটা। না জানি কত কষ্ট পেয়েছে! সুদূর দুঃস্বপ্নেও ওর যন্ত্রণার কথা ভাবতে পারি না।
মনে পড়ে যায় আরও অনেক গল্প, আরও অনেক নাম। ধর্ষণ করে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনা বাংলাদেশেই ঘটেছে, ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে নিশ্চয়ই।
ভারতের অবস্থাও একই রকম, প্রতি বিশ মিনিটে একটি ধর্ষণ ঘটে। দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্ষণ করে ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছে। ঘটনাটি রাজধানী দিল্লিতে বলে এত বেশি আলোড়ন, রীমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, বধূহত্যার আরও অনেক ভয়াবহ ঘটনা আছে।
এই সমস্ত গল্প মনে পড়ে, হতাশ লাগে। রাগে ক্ষোভে অসহায়ত্বে চিৎকার করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সত্যি বলছি, রাম, মুকেশ, অক্ষয়, বিনয় আর পবনকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি।
জ্যোতির যন্ত্রণা কল্পনা করার শক্তি আমার নাই, জ্যোতির মায়ের কষ্ট অনুভব করার কোনো ক্ষমতা আমার নাই।
কিন্তু মুকেশ আর রামের মা, অক্ষয়ের মা, স্ত্রী আর সন্তানের মুখও আমার চোখে ভাসছে। সতের বছরের যে ছেলেটি নাবালক হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে গেল, তার মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে।
রাম, মুকেশ, অক্ষয়, বিনয়, পবন- ওরাও কি ওই ছেলেটির মতই নাবালক নয়! সমাজই কি ওদের তৈরি করেনি! বৈষম্য, অসমতা আর ক্ষমতা-সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে, নারী-বিদ্বেষ জিইয়ে রেখে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত!
জনমতের চাপেই হোক আর দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যই হোক- এই রায় সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু, ধর্ষকদের ভয় দেখানোর জন্যই যদি এই রায় দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে সমস্ত ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডও নিশ্চিত করা দরকার। সমস্ত ধর্ষণের বিচার করা দরকার। সেটা কি ভারত রাষ্ট্র করতে পারবে? আমার মনে হয় না।
তবে আশার কথা এই যে এই মামলার ফলে ধর্ষণের বিচার করার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে ভারতে, পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রচলিত আইন। বাংলাদেশে আর কত ধর্ষণ হলে এমনটা ঘটবে?
ছোটবেলা থেকেই শুনেছি- পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়- কিন্তু কখনই কথাটার মানে বুঝতাম না। মুকেশকে দেখে, তার কথা শুনে, অক্ষয়ের মা, স্ত্রী আর সন্তানকে দেখে আজকে বুঝলাম।
উম্মে রায়হানা, সংবাদকর্মী