News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২২:০০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
আপডেট: ০১:১৮, ১ মার্চ ২০২০

বাপের জন্মে মুরগি খান নাই!

বাপের জন্মে মুরগি খান নাই!

আহ্‌সান কবীর
এটি আমার প্রবাস জীবনের ঘটনা। তখন কুয়েতের আলী আল সালেম এয়ারবেসের বাসিন্দা আমি। সব মিলিয়ে শ দুই আড়াই বাংলাদেশি সেখানে ছিলেন তখন।
এক দুপুরে শরীফ সাহেবকে দেখলাম যেন রকেটের গতিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছেন। দূর থেকে আমাকে দেখে তার হাঁটার গতি প্রায় দৌড়ে রূপ নিয়েছে।
ব্যারাক থেকে ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম লাঞ্চ সারতে। উনি লাঞ্চ সেরে ফিরছিলেন ব্যারাকে। মাঝপথে টক্কর।
দুজনের মাঝখানের দূরত্ব দুই ফুটে কমে আসতেই হার্ড ব্রেক কষলেন। তবে সাড়ে সাত শ সিসির মোটরবাইকের মতই ব্রেকের পরও তীব্র তেজ আর শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল তার হাবে-ভাবে। ততক্ষণে তার অনুসরণে আমিও হার্ডব্রেক করেছি—মানে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
এই যে ভাই, আহ্সান সাহেব! আচ্ছা বলেন তো, এই সরওয়ার কী একটা মানুষ না মানুষের বাচ্চা!
প্রচণ্ড বিক্ষোভে শরীফ সাহেবের গলা কাঁপছিল।  
এখানে বলে রাখি, বয়সে উনি আমার জ্যেষ্ঠ হলেও আমাকে বেশ সম্মান দেখিয়ে কথা বলতেন। আর সরওয়ার ওরফে বাচ্চু নামে যে লোকটার বিষয়ে তিনি বলছেন, তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা এখানকার দেশি-বিদেশি সবার জানা। বাচ্চু ভাই পুরো ষ্পষ্টবাদী-ঠোঁটকাটা আর কিছুটা বেপরোয়া স্বভাবের মানুষ। বিদ্রোহী কবির ভাষায় যাকে বলে, ‘আপনারে ছাড়া করি না কাহারেও কাউকে কুর্নিশ’ টাইপের আদমি।
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই লোকটির সঙ্গে আমার গভীর দোস্তি গড়ে উঠেছিল। তার পড়াশোনা-জানাশোনা আর অনুধাবন শক্তি ছিল অসাধারণ। বয়সে আমার চেয়ে বছর দশ-বারোর সিনিয়র এই লোকটিকে পারতপক্ষে কেউ ঘাটাতো না (শরীফ সাহেবও আমারচে কমপক্ষে ১৫ বছরের বড় হবেন)। তারপরও হররোজ এই-সেই নিয়ে কোনও না কোনও বিষয়ে উত্তেজনার ঘটনা ঘটেই যেতো আলী আল সালেম প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে। এসব ঘটনার অনেকগুলোরই একদিকে একা থাকতেন বাচ্চু ভাই আর বিপক্ষে সাত, আট, দশ বা বিশজনের জোট। কখনো ৪৩ জনের পুরো ব্যারাকের ৪২ জন লোক একদিকে আর বিপক্ষে বাচ্চু ভাই একা সংশপ্তকের মত লড়ে যেতেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো—‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিত’ থেকে উত্তরণে শান্তি বা সমঝোতার প্রস্তাবটা আমার মাধ্যমেই তাকে দেওয়া হতো।
এর কারণ ছিল-- হ্যাঁ, তিনি আমার কথা শুনতেন এবং আলী আল সালেম এয়ারবেসের সবাই মানে বাঙালিরা বিষয়টা জানতো।
তো এই বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে নতুন করে আবার কী ঘটলো! আমি কিছুটা স্বাভাবিক মুডে শরীফ সাহেবকে বলি, কী আবার ঘটলো? কী করেছেন উনি?
কী করছে মানে! কী করে নাই সেইটা বলেন! ওরে আইজকা আমি... ভাষাটা ব্রাত্য পর্যায়ে নামি নামি করছিলো তার।
আরে ভাই এত রাগ করার কী আছে! ঘটনা...
আপনে তারে বইলা দিয়েন... এই কুয়েতটা অর বাপের জমিদারি না...
আমি এবার সহমর্মী হয়ে বলি, শরীফ সাহেব, প্লিজ ঘটনাটা যদি...
আমার দমকলকর্মীর ভূমিকা এ পর্যায়ে যেন একটু সাফল্যের দেখা পায়। মনে হলো আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসছে। আমার দিকে নিরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লম্বা লম্বা দু’তিনটা দম নিয়ে শরীফ সাহেব বলা শুরু করেন, ক্যান্টিনে আমি খেতে বসেছি। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ সরওয়ার এসে আমারে বলে— অই মিয়া! বাপের জন্মে... ভাই ওর এই কথা কইতেও আমার গা জ্বলতেছে...
কী দিয়েছে ক্যান্টিনে আজ?
চিকেন, চিকেন রোস্ট আর...
আলী আল সালেম এয়ারবেসের এই ক্যান্টিনের সুনাম আছে বাইরেও। হরহামেশাই দুপুরে অন্যান্য মাছ-মাংস তরকারির সঙ্গে দেওয়া হয় শুকনো করে ভাজা মুরগির রান বা সিনা, বেশ বড় আকারের এবং সুস্বাদু। তখন আমরা প্রায় সবাই যেটা করি, টেবিল থেকে সসের বোতলটা নিয়ে... হ্যাঁ, সস দিয়ে বেশ আয়েশ করে ধীরে সুস্থে প্রথমে রোস্টটা খেয়ে নেই। এরপর বাঙালি কায়দায় অন্যান্য খাবারে মনোযোগ দেই।
তারপর কী হলো? শরীফ সাহেবকে তাড়া দেই আমি।
তারপর মানে! হে আমারে কয়...আচ্ছা বলেন তো সাহেব, আমার কী মুর্গি খাওয়া অর কাছে শিখতে হইবো? ও আমারে কয়— আমি নাকি জিন্দেগানিতে মুর্গি খাই নাই!  
এতবড় কথা বলছে? এবার আমিও বিস্ময় চেপে রাখতে পারি না।
ও যে কীভাবে কইছে সেইটা আপনে শুনলে (এবার ফের অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন শরীফ সাহেব)...মন চাইছিলো স্টিলের প্লেটটা মাথার উপর তুইল্লা মাইরা ওর চান্দিটা গুঁড়া গুঁড়া কইরা দেই (এ পর্যায়ে তিনি কথার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বেখেয়ালে মুকাভিনয় করে দেখান কীভাবে তিনি প্লেটটা দিয়ে মারতেন বাচ্চু ভাইয়ের মাথায়)।
তিনি বলে চলেন, খালি বিদেশের বাড়ি বইলা...আমি... দেশের মান-ইজ্জত...
আপনে অরে কয়া দিয়েন! এরপর আর...
জ্বী, আমি তাকে বলবো! এটা তো খুবই খারাপ কথা। খামোখাই... (আমি নিজেও ভাবতে থাকি, আসলে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে চলাফেরাটা মুশকিল-ই হয়ে যাচ্ছে)।
ওদিকে শরীফ সাহেব মনে জমে থাকা ক্ষোভ-কষ্ট-জ্বালা আমার সঙ্গে ‘শেয়ার করে’ মনে হয় কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন এবার। আমার প্রতি এবার তার স্বাভাবিক সম্মানবোধটা ফিরে এল। একটু ঠোঁটফাটা হাসি দিয়ে বললেন, বস! মনে কিছু নিয়েন না। আমি আসলে...
মো মুশকিলা, সাদিক!  অর্থাৎ ‘কোনও সমস্যা নেই, বন্ধু’। আমি যে আসলেই কিছু মনে করিনি শরীফ সাহেবকে এটা বোঝাতে কথাটা আরবিতেই বলি।
শেষে আরেক দফা দুর্বল একটা হাসি দিয়ে আমাকে ছেড়ে ব্যারাকের দিকে ফিরে গেলেন তিনি।
বাচ্চু ভাই আর শরীফ সাহেব থাকতেন একই ব্যারাকে, ৭ নম্বরে, আমি একটু উত্তরে, ৯ নম্বরে।
এরপর ব্যস্ততার কারণে দু’একদিন বাচ্চু ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাই না। তবে তারপর দেখা হলেও বিষয়টি নিয়ে তাকে কোনও প্রশ্ন করি না। এককথায় আমি হয়তো কিছুটা বিরক্তও হয়ে পড়েছিলাম তার ওপর। আমরা একসঙ্গে খেতে বসি, গাড়িতে পাশাপাশি সিটে বসে যাওয়া আসা করি, দেশ থেকে চিঠি আসলো কি না, কিংবা সাদ্দামের মতিগতি কী, আরব তথা কুয়েতিদের কিছু বিটকেলে আচরণ, দেশের খবর—টুকটাক আলোচনা হলেও তাকে শরীফ সাহেবের অভিযাগের বিষয়ে আমি প্রশ্ন করি না। তবে উনি প্রশ্ন করতে চাইছিলেন। কারণ, তার বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ এভাবে ধামাচাপা পড়তে পারে না। আমার কাছে তো কেউ না কেউ বিষয়টা পাড়বেই। প্রমাণ পেলাম চার-পাঁচদিনের মাথায় যখন তিনি নিজেই আমাকে শুধালেন,শরীফ সাহেব কিছু বলেছেন আপনাকে?
আমি নিস্পৃহভাবে বলি, কোন বিষয়ে?
তার মুখে সহজাত গভীর আমুদে হাসিটা ফুটে উঠলো। বললেন, ক্যান্টিনের বিষয়ে কিছু বলেননি?
হ্যাঁ।
কী বলেছে?
না, কী আর বলবে! আপনি তার সঙ্গে যা করেছেন খামাখা খামাখা...
আরে সাহেব! খামাখার কী দেখলেন? উনি কী করেছে হেইটা কয় নাই!
কী করেছে?
আরে আপনে দেখলে কইতেন! সার্জেন্ট মেসে (ক্যান্টিনে) গেছি। গিয়া দেখি ওইখানে ফরাসি, কুয়েতি, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানিরা খাচ্ছে। সেখানে আমাদের শরীফ সাহেবও আছেন। তিনি মুরগির ঠ্যাং এমনভাবে খাচ্ছিলেন...
আমি মুখচোখ কিছুটা গম্ভীর করে বলি, মুরগি উনি যেভাবেই খাক, তাতে আপনার কী? আপনি শুধু শুধু গায়ে পড়ে...
এবার ক্ষেপে যান বাচ্চু ভাই। গলা চড়িয়ে বলেন, আরে রাখেন সাহেব ‘আপনার কী’! আমার অনেক কিছু হইছে। হে আমার দেশি না! মুরগির হাড্ডি এমন কইরা চিবায়া খাইবার লাগছে যে মনে হয় ‘কুত্তা-বিলাই’ও...
এবার আমিও গলা চড়াই-- যেভাবেই খাউক, আপনার সমস্যাটা কী? আপনেরে কি এইগুলি দেখার জন্য দায়িত্ব দিছে বাংলাদেশ সরকার বা কুয়েত সরকার?
আপনে বুঝতেছেন না আমি আমি কী কইতেছি? ওইখানে নানান দেশের লোকেরা ছিল। তাগোর সামনে একজন বাঙালি এইভাবে মুরগির হাড্ডি খাইবো...
হাড্ডি তো আমিও খাই, কই আপনি তো আমারে কিছু কন না!
আরে হেইটা তো আমিও খাই। কিন্তু হের খাওয়ার স্টাইল দেখলে কইতেন। মনে অয় কত বছর পর জানি খাইতে বইছে...রাক্ষসের মত...আর ব্যাপারটা অন্যরা তাকিয়ে দেখছে। বলেন, জাতি হিসেবে আমাদের একটা মর্যাদা আছে না! তাই আমি সামনে গিয়ে তাকে বললাম, ‘অই মিয়া, বাপের জন্মে মুরগি খান নাই!’ আমি পরিস্থিতিটার চিত্রায়ন মনে মনে দেখে নিলাম। শিউড়ে উঠলাম যে শরীফ সাহেব তার হাতের মোটা স্টিলের চারকোনা প্লেটটা দিয়ে কেন উনার মাথাটা...
আরও মনে পড়লো, শরীফ সাহেবও দেশের মান-ইজ্জতের প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন। অর্থাৎ সরকারি আর বিরোধী দল একই তালগাছ নিয়া লড়াই করতেছে। আমি এবার কিছুটা হতাশ হই। ওদিকে বাচ্চু ভাই বলে চলেন, একজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক এবং অসুস্থ বা পাগল না! এমন ব্যক্তি যদি অমন করে-- অন্যদের কাছে আমাদের স্ট্যাটাসটা থাকে কই! দেশে হইলে তো আমি তারে... চিন্তা করা যায় না, বিদেশে এসে একজন বাংলাদেশি এমন করতে পারে! এমনিতেই তো বিদেশিরা আমাগো নানানভাবে আন্ডার-এস্টিমেট করে—এসব তো আপনিও জানেন...
দেশে আর জাতি নিয়ে আবেগঘন বয়ান। আমি জবাব খুঁজে পাই না। তারপরেও আমার তো কিছু কইতে হইবো! আমি গলায় জোর এনে বলি—জাহান্নামে যাক সব! এসব নিয়ে এত ভাবার দরকার নাই। আপনার ঠিক হয় নাই এটা। তার সঙ্গে বিষয়টা মিটায়া ফালান। তিনি মনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন...
এবার বাচ্চু ভাই হেসে ফেলেন। আরে কষ্টের কী আছে, মশাই! এসব... তার সঙ্গে তো কালকেও ক্যারম খেলা...
বুঝলাম, বন্দুকের গুলি ফেরত আসতে পারে, কিন্তু তিনি যা বলেছেন—সেই কথা ফিরিয়ে নেওয়া সাইবেরিয়ার জমাট তুষারে সবুজ ফসল ফলে যাওয়ার মতই অসম্ভব ব্যাপার।
এরপর অনেক দিন পার হয়েছে। অনেক ঘটনা, অনেক সুখ-দুঃখের প্রলেপ মাখানো প্রবাস কাল শেষ হয় আমার। চাকরি ছেড়ে চলে আসি দেশে। বাচ্চু ভাই, শরীফ সাহেব— ইনারা থেকে যান।
এরপর নিয়মিত বিরতিতে কুয়েত থেকে পরিচিত বাংলাদেশিরা একে একে দেশে আসতে থাকেন— কেউ ছুটিতে, কেউ আমার মত স্থায়ীভাবে। অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, কথা হয়। এরকম একজন হলেন, ইব্রাহিম ভাই। তিনি আরেক ব্যক্তি যার সঙ্গে কুয়েত প্রবাসের সময়টায় আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। লম্বা চওড়া বিশাল দেহের ইব্রাহিম ভাই ভাল আরবি জানতেন আর খুব কাজের লোক ছিলেন। এ কারণে কর্মকর্তা থেকে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত কুয়েতিরা তাকে খুব পছন্দ করতো। আলী আল সালেম বেসে বাংলাদেশিদের যে কোনও সমস্যা সমাধানে আমার স্বপ্রণোদিত সব ইতিবাচক কাজে তিনি সহযোগিতা করতেন, পরামর্শ দিতেন। এমনকি বিপদে পড়া লোকটি যদি তার প্রতিপক্ষও হয়— সেসব ক্ষেত্রেও পরহেজগার আর নিয়মনিষ্ঠ ইব্রাহিম ভাই আমার ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে কিছুটা বেজার মুডে হলেও তৎপরতা চালাতেন।    
ঢাকার গজারিয়ার সন্তান এই সজ্জন লোকটি উত্তরার কাছকাছি ফায়দাবাদ এলাকায় থাকতেন। দেশে ফিরেছেন খবর পেয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অনেক সুখ-দুঃখের কথা হলো। তিনি আমার জন্য বেশকিছু উপহার নিয়ে এসেছেন। কুয়েতে কে কেমন আছে প্রশ্ন করতেই উনি হাসলেন—বললেন, যারে যিমুন দেইখা আইছেন সব তিমুনই আছে। তবে একটা ঘটনা আপনি শুনলে হাসতেও পারেন আবার কষ্টও পাইতে পারেন।
কী ঘটনা?
শরীফ সাহেব!
কী হইছে তার?
যেহেতু হাসিও আসতে পারে বললেন, তাই আমি নিশ্চিত যে তিনি মারা যাননি। কিন্তু কী হতে পারে এমন ঘটনা যা হাসি এবং কষ্টের কারণ হয় একই সঙ্গে! প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখি, শরীফ সাহেবকে ইব্রাহিম ভাইও খুব একটা পছন্দ করতেন না। তার সঙ্গত কারণও ছিল। যাহোক, আমি ফের প্রশ্ন করি, কী হইছে উনার?
উনার ওয়াইফ, মানে শিপন-রিপনের মা...
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে অনেক কথা। আমাদের বেসের প্রায় লোককেই ছুটিতে দেশে ফেরার আগে শরীফ সাহেব গিয়ে ধরতেন যেন তার মিরপুরে বাসায় একবার পদধূলি দেন। তার ছেলে দুটোকে দেখে আসেন। আর সবচেয়ে বেশি যেটা বলতেন, তা হলো তার স্ত্রী অর্থাৎ রিপন-শিপনের মা অসাধারণ গুণী এক নারী। তার হাতের রান্না খেলে আপনি বলবেন যে কী খেয়েছেন। একবার শুধু তার বাড়িতে গেলে... একথা আমাকেও একাধিকবার বলেছেন ছুটিতে আসার আগে, এমনকি আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার সময়েও একই অনুরোধমাখা আবদার ছিল। মনে পড়লো আমার নোটবুকে তার বাড়িতে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়ে এঁকে দেওয়া ম্যাপটির কথাও। কিন্তু কী হয়েছে রিপন-শিপনের মায়ের? যা একইসঙ্গে হাসির আর কষ্টেরও!
ওদিকে ইব্রাহিম ভাই চুপচাপ আমার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছেন, আমি বিষয়টা শুনে কিভাবে হজম করবো। আমি তাড়া দেই, আরে বলেন না ঘটনা কী হইছে?
ঘটনা আর কী হইবো! শরীফ সাহেবের বউ তার ছেলেদের প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে...
কী করছে?
ভাইগা গেছে। যাওয়ার সময় সোনা-দানা, টাকা-পয়সা সব নিয়া গেছে!
ইব্রাহিম ভাই কেন বলেছিলেন কষ্টও লাগতে পারে আবার হাসিও আসতে পারে—তা নিমেষে পরিষ্কার হয়ে গেল। শরীফ সাহেবের কথায় চালচলনে উনার বউ-পাগলা পরিচিতিটা খুবই প্রকট ছিল। যে কোনও বিষয়ের কথাবার্তা আলোচনায়ও কায়দা মত উনি উনার গুণবতী স্ত্রীর কীর্তন করতেন হরদম। এ নিয়ে মজাক-তামাশা কমবেশি আলী আল সালেম বেসের বাসিন্দা বাঙালিরা অনেকেই করেছেন। তাই এমন বউ যখন ইমুন কেলেঙ্কারি...তাৎক্ষণিক এই `হিট-হট সসি সংবাদে` `ঘনিষ্ঠ বন্ধু` থেকে নিয়ে উনার পরিচিত মহল মুচকি হেসে উঠতেই পারে। কিন্তু এটাও সত্য, ব্যাপারটা নিদারুণ কষ্টের। এর পেছনে দোষ শরীফ সাহেব না তার গুণবতী স্ত্রীর-- কার ছিল জানি না। তবে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা মানুষ মাত্রেরই হৃদয়ে দন্তবেদনা জাগিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।   
এদিকে, আমি কোনও কথা বলি না। ওদিকে, ইব্রাহিম ভাই স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন—শরীফ সাহেবের যে কী অবস্থা হইছিলো—দেখলে কইতেন। পুরা উন্মাদ! আর আলী আল সালেম বেসের বাঙালিরা তো তারে যিমুন পায়া গেল। লেংটা পাগলের পিছে রাস্তায় যিমুন পোলাপান লাইগা থাকে—ঢিল ছুড়ে মারে, অনেকটা সেইরকম। ঢিল সত্যি সত্যি কেউ মারে নাই, তবে...
শেষে কী হইলো! উনি কী আছেন এখনও কুয়েতে! পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন?
এইখানে একটা কথা আছে। আপনার সাদিক, মানে মাশ-সাব মানে বাচ্চু (বাচ্চু ভাই একসময়ে দেশে মাস্টারি করেছেন, সেনা সদস্যদের কি এক কোর্সে যেন অংক না বাংলা পড়িয়েছেন। এ সূত্রে তাকে মাস্টার সাহেব বা খাতির করে কেউ কেউ মাশ-সাব বলে ডাকতো) যা করেছে তার জন্য...
এই প্রথম আমি ইব্রাহিম ভাইয়ের মুখে অবলীলায় বাচ্চু ভাই সম্পর্কে নিস্প্রেহ প্রশংসাবাণী শুনলাম। তারা দুজনেই আমার প্রিয়জন এবং ভাল মানুষ ছিলেন—কিন্তু দু’জনের মধ্যে একটা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব সারাক্ষণ ছিল। আমি আগ্রহ নিয়ে ইব্রাহিম ভাইকে প্রশ্ন করি, কী করেছে বাচ্চু ভাই?
হে তো পুরা দেয়ালের মত ঘিরা রাখছিলো শরীফ সাহেবকে। হে না থাকলে লোকটা তো পুরা মেন্টাল হয়া গেছিলো। বাচ্চু তার কাম-কাইজ ফালায়া, দিন নাই রাইত নাই হেরে আগলায়া রাখতো! বাচ্চুর মত লোক না থাকলে শরীফরে সবতে মিল্লা খাঁচায় বন্দি চিড়িাখানার বান্দরের মতন...
প্রিয় পাঠক, আমি মোটেও অবাক হইনি বাচ্চু ভাইয়ের এই ভূমিকার কথা শুনে।কারণ, এই লোককে আমি চিনেছিলাম ভাল মতই। তবে উনি এতটা করেছেন শুনে মন আনন্দে ভরে উঠে আমার। মনে পড়লো বাচ্চু ভাইকে নিয়ে আরেকটি ঘটনা।
আলী আল সালেমের বাসিন্দা জামাল নামে আরেক বাংলাদেশি ভাই আমার কাছে আসতেন, ভালমন্দ কথাবার্তা বলতেন। তার একটা দাবি ছিল, তিনিও ঢাকার ছেলে আর আমিও ঢাকার ছেলে। আমি পুরান ঢাকার ছেলে—সে সুবাদে কোথাও ডিস্ট্রিক্টইজম দেখানোর সুযোগ হয় না। কারণ ঢাকাইয়াদের সব যায়গায় খুব একটা পাওয়া যায় না। আর আমি নিজেও জেলাইজমের পক্ষপাতি নই। কিন্তু জামাল সাহেব এসে জোর করেই আমার সঙ্গে বিষয়টার দাবি তুলে খাতির জমাতেন বলা যায়। ভদ্রলোক সহজ সরল আর ধার্মিক। আমি তার সঙ্গ বলা যায় উপভোগই করতাম। বয়সে তিনি বাচ্চু ভাই আর ইব্রাহিম ভাইয়েরও অগ্রজ। একদিন এই জামাল সাহেব আমার কাছে আসলেন। বোঝা গেল কিছু একটা বলতে এসেছেন। আমি বললাম, গেরাই (অর্থাৎ একই এলাকাবাসী) বলেন, খবর কী?
বিদেশে দেখেছি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার লোকজন একই জেলার বা এলাকার লোকদের পরস্পর গেরাই বলে সম্বোধন করে থাকে। সে সূত্রে জামাল সাহেব গেরাই ডাকলে খুশি হন। তিনিও হাসিমুখে বললেন, গেরাই একটা কথা অনেকদিন ধইরা বলতে চাইতাছি।
বলেন।
না মানে, আপনি তো ওই হাদিসটার কথা জানেন, যেখানে বলা হইছে দুনিয়ায় যার লগে যার দোস্তি বা সম্পর্ক থাকে তার হাশরও তার সঙ্গেই হইবো মানে পরকালেও সে তার সঙ্গী হইবো।
হ্যাঁ জানি তো।
আপনি এইটা মানেন তো?
না মানার কী আছে? আমি কিছুটা ডিপ্ল্যোমেটিক উত্তর দেই।
তাইলে এখন বলেন তো—এই মাস্টার মানে শহীদ সরওয়ারটার সঙ্গে আপনার এত খাতির রাখার কী আছে? আপনি বুঝতেছেন তো? হাশরে আপনার...আপনারে তো আমরা খুব অন্যরকম...
তার মানে ইনারা নিশ্চিত যে মৃত্যুর পর বাচ্চুভাই দোজখবাসী হবেন আর সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সূত্রে আমিও তার সঙ্গী হবো! আমার মত অমন কাছের লোককে তারা চুপচাপ নরকবাসী হতে দিতে চায় চান না!  
সম্ভবত বিশাল একটা পক্ষের পক্ষে কথা বলতে এসেছেন ‘গেরাই’ জামাল সাহেব। সাধারণত বাচ্চু ভাই সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে তারা আমার কাছে আসে। কিন্তু এখানে বিষয় বাচ্চু ভাই সংক্রান্ত হলেও মূল প্রসঙ্গ আমি। আমাকে কিছু বলার জন্য ইব্রাহিম ভাইকে বলার কথা। কিন্তু এটাও সবাই জানে—ইব্রাহিম ভাই আমাকে আমার বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে এমন কিছু বলবেন না কখনো। তাই, ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসেবে গেরাই জামালকে মাধ্যম করা হয়েছে। মূল টার্গেট—বাচ্চুকে একা করে ফেলা।
বিদেশে থেকে কাজ-কর্ম আর খাওয়া-দাওয়ার পর বাঙালির প্রধান কাজ সোজা বাংলায় যাকে বলে আঙলা-আঙলি করা—সেই কাজে তাদের প্রধান বাধা বাচ্চু ভাই। বাচ্চু ভাই নামাজ-রোজায় ততটা নিয়মানুবর্তী ছিলেন না। কথা বলতেন মুখের ওপরে, অন্যের দোষটা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন (আমার ক্ষেত্রেও), ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি, দলাদলি না-পসন্দ করতেন, আর জানতেন প্রচুর। এসব কারণে তিনি নিজে নোয়াখালীর লোক হয়ে এসব কারণে খোদ নোয়াখালীর লোকজনও তার পাশে থাকতো না। তার বিছানার পাশে থাকতো একগাদা বই। ভাই গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদ করা বাংলা কোরআন শরীফ, ফরাসি দার্শনিক দ্যানিশ দিদরোর অসাধারণ উপন্যাস অদৃষ্টবাদী, ইমাম গাজ্জালীর কিমিয়ায়ে সা`আদাত, বাৎসায়নের কামসূত্রসহ অসাধারণ সব এপিক গ্রন্থ। আমি তার নিত্য পাঠ্যের মধ্যে  কামসূত্র দেখে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। এ বিষয়ে আমি কোনও প্রশ্ন করার আগে তিনিই একদিন বললেন-- সাধারণ মানুষ কামসূত্র বলতে এই মাস্টারপিসটিকে শুধু যৌনতায় আবর্তিত বিষয়ই মনে করে। আসলে কিন্তু এতে মানুষের আচরণগত অনেক বিষয়, সামাজিক-আর্থিক প্রসঙ্গও আছে। বিশাল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ এক আকর গ্রন্থ এটা।
যাহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম তার সঙ্গে। বাচ্চু ভাই প্রসঙ্গে গেরাই জামালের কথায় আমি থমকে দাঁড়াই। তেজের সঙ্গে বলি, দেখেন, এই আলী আল সালেম বেসে আমরা আড়াই শ`র মত বাঙালি আছি। এরমধ্যে যদি আপনি আমাকে বলেন, সবচেয়ে সেরা মানুষটারে খুঁজে নিতে-- তাহলে আমি বাচ্চু ভাইকে বেছে নেবো। উনি মানুষ হিসেবে অনেক উন্নত।
জামাল সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আর কিছুটা হতাশা নিয়ে চেয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখেমুখে প্রিয় মানুষটাকে জাহান্নামে যাওয়া থেকে কোনওমতেই বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ ফুটে উঠলো।                
শরীফ সাহেবের মহাবিপদে বাচ্চুভাই কী ভূমিকা রেখেছেন-- ইব্রাহিম ভাইয়ের মুখে তার বয়ান শুনে পুরনো এসব ঘটনা আমার মানসপটে ভেসে উঠলো। আমি মনে মনে সন্তোষ প্রকাশ করলাম-- রেগে গিয়ে যাই বলে থাকি সেদিন জামাল সাহেবকে, মনে হয় না খুব একটা বাড়িয়ে বলেছি। আর এমন লোক যদি দোযখবাসী হন-- খোদাতা`লা তাহলে বেহেস্তবাসী কাদের করবেন?
এরপর আবার দিন যেতে থাকে। খবর পাই জামাল সাহেব দেশে ফিরেছেন। হাতিরপুলে কম্পিউটার পার্টসের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সুস্থ স্বাভাবিক আছেন।আমার খোঁজখবর করেছেন কয়েকজনের কাছে।    
এরপর আবারও দিন যেতে থাকে। শেষপর্যন্ত কুয়েতের পাট চুটিয়ে দেশে ফিরলেন বাচ্চু ভাই-ও। আমি ঈদের মত খুশী হলাম। সুযোগ হলেই উনি আমার এখানে পুরান ঢাকায় আসেন, আমি তার ওখানে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মানিকদীতে যাই-- তার এলাকার প্রায় সব বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, কারও কারও সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়। আমার কিছু বন্ধুও তারগুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন অল্পদিনেই। একপর্যায়ে শরীফ সাহেবের প্রসঙ্গ উঠে। মুচকি হেসে বললেন, একদিন যেতে হবে তার ওখানে, আপনাকে নিয়েই যাবো।
এবং সেই মোতাবেক একদিন দুজনে রওনা হলাম হাতির পুল। ইস্টার্ন প্লাজার কাছের সেই মার্কেটে গিয়ে পেলাম শরীফ সাহেবকে। বিশাল দোকান দিয়ে বসেছেন। কিন্তু যে মর্যাদায় উনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন-- তা রীতিমত অবাক করার মতো। মনে হলো কোনও রাজকীয় অতিথি আমরা। তার কর্মচারীদের ওপর হইচই শুরু করে দিলেন।           
হাল্কা নাস্তার পর তাড়া লাগালেন লাঞ্চের জন্য এবং আমাদের সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে আমাদের নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। এক ফাঁকে তাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, শরীফ সাহেব, কেমন আছেন?
আরে স্যার কেমন আছি মানে! অনেক ভালো আছি। আর এইটাতো সম্ভব হইছে আপনার বন্ধুর জন্য। যে না থাকলে আল্লাহ আমার যে কী হইতো!
আমি পটভূমি জানি, তবে তার সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানি বলেই এবং সেই `বাপের জন্মে মুরগি...` প্রসঙ্গ মনে দাগ কেটে থাকায় এবার একটু উসকে দিয়ে দেখতে চাই শরীফ সাহেব কী বলেন তার একদার চরম অপছন্দের এই লোকটি সম্পর্কে।
আমরা হাঁটছি পাশাপাশি। শরীফ সাহেব আমার কানের কাছে মুখ এনে সামনে একা হাঁটতে থাকা বাচ্চু ভাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, মানুষ না ভাই, উনি একটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা!
কিন্তু আপনি যে...
উনি বুঝে যান আমি কী ইঙ্গিত করেছি। হেসে বলেন, আরে রাখেন ওইসব! মানুষ চেনা যায় বিপদে। এই লোক আমার রক্তের কেউ না, বন্ধু না, প্রতিবেশী না, দেশে থাকতে কোনও পরিচয়ই ছিল না-- কিন্তু সে যে আমার চরম সময়ে আমারে কীভাবে আগলায়া রাখছে স্যার, আপনি না দেখলে... হে আমারে আমার মায়ের মত আগলায়া রাখছিলো ওই সময়। না হইলে তো আমি পাগলই হয়া যাইতাম!
আমরা একটা সাধারণ রেস্তোরাঁয় ঢুকছিলাম। তিনি হায় হায় করে উঠলেন। আরে, আপনারা আসছেন, আমার ওস্তাদ আসছে, আমার বস আসছে-- আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে আজকে-- তারে কী যেইখানে সেইখানে খাওয়াইতে পারি।
আমাকে আবারও বললেন, উনি একটা সেইন্ট মানে দরবেশ রে ভাই।
বলে তখনকার হাতির পুলের সবসেরা রেস্টুরেন্টের একটায় নিয়ে গেলেন আমাদের।   বিষয়টার এত বিশদ বর্ণনা করছি এ কারণে যে, একজন কঠিন ধরনের মিতব্যয়ী হিসেবে শরীফ সাহেবের পরিচিতি ছিল আমাদের কাছে। সেই লোক আমাদের জন্য এতকিছু করবে এটা বেখাপ্পাই ঠেকছিল।
তবে একথাও মনে পড়লো, কুয়েতে আমি সনি`র তৈরি বেশ দামি একটা টিভি (সাধারণ টিভির প্রায় চারগুণ দাম ছিল) কিনেছিলাম। আনকমন একটা পিস ছিল সেটা। প্রথমদিককার ওয়াইডভিশন। শরীফ সাহেব এর কিছুদিন পর আমাকে নিয়ে আমার পছন্দে আরও বেশি দামে বিশাল এক টিভি কিনলেন-- তার স্ত্রীর জন্য। মনে আছে সনির ওই মডেলটার নাম ছিল-- কিরারা বাসসো।কথাটা মনে পড়ায় আবারও খারাপ লাগলো-- অমন ভালোবাসার ধন স্ত্রী কেন যে চলে গেলেন তাকে ছেড়ে? এটা কি স্বামী প্রবাসে থাকার কারণে শারীরিক ভালোবাসার ক্ষুধা মেটাতে না পারার ক্ষোভ-কষ্টে! নাকি আত্মিক-শারীরিক দুই ভালোবাসার`ই অভাব ছিল?
আমি এখনও কাউকে দোষ দেই না, যেহেতু সত্যিকারের পটভূমিটা জানা নেই আমার।
লাঞ্চের পরে শরীফ সাহেব আমাদের আরও কী কী খাওয়ানো যায় সেই চিন্তায় অস্থির।
আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসলাম আবারও যাওয়ার পাক্কা প্রতিশ্রতি দিয়ে।
কিন্তু এরপর আর বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়া হয়নি শরীফ সাহেবের ওখানে। মানুষের প্রতি মমত্ব, স্নেহ-ভালোবাসা আর সর্বোপরি দায়েত্বিবোধের জ্বলন্ত উদাহরণ, স্বদেশীর মর্যদা তুলে ধরতে দুঃসাহী মনোভাবের বাচ্চু ভাই, যিনি দেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে ভেবে চরম বেপরোয়া ভূমিকা রাখতে পারেন, আবার একজন মানুষ যিনি তাকে অন্তর থেকে অপছন্দ করেন-- সেই লোকের চরম বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ান একা সবার বিরুদ্ধে-- এমন মানুষটি কোথায় আছেন জানি না। সত্যিকারার্থে আমাদের অন্তরকে কাঁদিয়ে দলে-মুচরে তিনি চলে গেছেন অনন্তের পথে। ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেন।
ভাবি, একজন সাধারণ মানুষ বাচ্চু ভাই যেভাবে অপরকে নিয়ে ভাবতেন, পরোপকার চিন্তায় বিভোর থাকতেন, পান থেকে চুন খসলেই কঠোর শাসনের প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতেন নিজের তাগিদে আবার তেমনি বিপদে পড়া কাউকে উদ্ধারের জন্য জান-কোরবান পণ করে এগিয়ে যেতেন বুক পেতে দিয়ে-- তার তুলনা কোথায় খুঁজে পাই! আমার একটা গোপন আশা ছিল যে বাচ্চু ভাইয়ের মত মানুষ মন্ত্রী হওয়া উচিৎ। কিন্তু... আমাদের নেতানেত্রী, আমলা, ব্যবসায়ীরা যদি কিছুটা শিক্ষা অন্তত বাচ্চু ভাইয়ের কাছ থেকে পেতেন! আহ! কত ভালই না হতো! আর যাই হোক, ক্ষমতার জন্য চলমান এই মানুষ পোড়ানোর বীভৎস-উৎসব সংস্কৃতি দেখতে হতো না।
বাচ্চু ভাই, আপনি যেখানে আছেন সেখানে আমাদের স্থান হবে কী না জানি না-- কিন্তু সেখানে নিশ্চয়ই মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ নেই, নেই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ভয়াবহ নারকীয় পরিবেশ, পুলিশের জলকামান-টিয়ার শেল নেই, নেই ক্রসফায়ার আর গুম-খুন-অপহরণ!কারণ আপনি ছিলেন সত্যিকারের একজন সোনার মানুষ! এ ধরনের মানুষদের স্থান কোথায় হয়-- তা আমাদের মত স্বার্থপর, টকশোপ্রেমি, ফেসবুক আসক্ত বাঙাল অনুমানও করতে পারবে না।
পুণশ্চঃ বাচ্চু ভাইয়ের মুত্যু সংবাদ শুনে শরীফ সাহেবের প্রতিক্রিয়া ছিল, ভাই, ভাল মানুষ থাকে না! উনি তো ছিলেন দরবেশ...
(সঙ্গত কারণেই শরীফ সাহেব ও জামাল সাহেব পরিচয়ের দুজনের আসল নাম এবং দুই শিশু শিপন-রিপনের আসল নাম-পরিচয় গোপন করা হলো। অন্য ঘটনা আর নামগুলো সব সত্য। স্মৃতি থেকে লেখা, তাই ঘটনার বর্ণনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি চিত্রটা হয়তো ফুটিয়ে তোলা যায়নি, নিজের কথা বেশি এসে গেছে-- সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী)           

এএইচকে/
   














নিউজবাংলাদেশ.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়