News Bangladesh

নিউজ ডেস্ক  || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
আপডেট: ০৯:০৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ, চটকদার নামে হরিলুট প্রকল্প

ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ, চটকদার নামে হরিলুট প্রকল্প

ফাইল ছবি

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করে পরে স্মার্ট বাংলাদেশের নামে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে (আইসিটি) একের পর এক প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। চটকদার নানা নামে একের পর এক প্রকল্প আর কর্মসূচি নেওয়া খাতটির সুফল না মিললেও, অর্থনীতির শ্বেতপত্রে চিহ্নিত হয়েছে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে। 

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, ব্যক্তিস্বার্থে নেয়া হয়েছে হাজার কোটি টাকার তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প; যেখান থেকে লোপাট হয়েছে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্তে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয়। সে অনুযায়ী শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতকে দুর্নীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি খাত (আইসিটি) বাংলাদেশের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং আমাদের জন্য নতুন ক্ষেত্র। নতুনত্বের সুযোগ নিয়ে এবং অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় হাতেগোনা কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এসব প্রকল্পের কাজ পেয়েছে, যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থ লোপাট করেছে।

দেবপ্রিয় বলেন, কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার অধিক মূল্যে কেনা হয়। আর একটি বিষয় হলো অনেক প্রকল্প বা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করার কথা বলে আরও বড় অঙ্কের প্রকল্প করা হয়েছে যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটাও যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

প্রকল্পে যে ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন বা কাজের কথা বলা হয়েছে তা আদৌ হয়নি। এছাড়া আইটি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে দেশের সুরক্ষা, দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আইসিটি খাতে প্রকল্প গ্রহণ করাটা জরুরি। তবে সেটা অব্যশই দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।

আইসিটি খাতে দুর্নীতি ও অপচয় রোধে সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেয়ার তাগিদ দেন তিনি।

আইসিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৫টি প্রকল্প নেয়া হয়, যার ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর ৩৪টি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৭৩ কোটি টাকা। ব্যয়বহুল প্রকল্প আর কর্মসূচি হাতে নেয়া হলেও সুফল মেলেনি। তার প্রমাণ, আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ১৭০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা আইসিটি খাতের একটি প্রকল্পকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যেটিতে ৫২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও খরচ করা হয় ৭৭৪ কোটি টাকা।

দেবপ্রিয় অভিযোগ করেছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই বড় বড় প্রকল্প পাস করা হয়েছে। সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বড় দুর্নীতির।

শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই ঘটনা যুবসমাজ ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের হতাশ করে। কারণ জনগণের করের অর্থ অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ অপচয় করা হয়। এসব প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব ছিল এবং অভিযোগ ওঠে যে, এগুলো তৎকালীন শাসন ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছিল।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনকালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নির্মাণ এবং পরবর্তীতে ‘২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

এই বাজেটের বেশিরভাগই পরিকাঠামো প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে, যা নিয়ে এখনও আইসিটি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যৌক্তিকতার প্রশ্ন উঠছে। উদাহরণ স্বরূপ, বড় শহরের বাইরে অবস্থিত হাই-টেক পার্কগুলো বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তরুণদের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্থানীয় অ্যাপ ও গেম উন্নয়ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও উদ্ঘাটিত তথ্য থেকে দেখা গেছে- এসব প্রকল্প মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের এবং তাদের পছন্দের সরবরাহকারীদেরই উপকৃত করেছে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পক্ষ থেকে চলমান প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করা হয়, যেখানে অনেক অযৌক্তিক প্রকল্প সংকোচন করার সুপারিশ রয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়া প্রকল্পগুলোতেও অসঙ্গতি খুঁজে বের করার জন্য আরও গভীরে অনুসন্ধান করবে।

সরকারি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে কীভাবে যৌক্তিকতা দেখানো হয়েছে তার একটি উদাহরণ হিসেবে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে- ২০১৩-১৮ সালের আইসিটি ডিভিশনের প্রকল্প ‘লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রজেক্ট’। এই প্রকল্পের ব্যয় ৫২১ কোটি ৯৭ লাখ টাকার মূল বাজেট থেকে ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭৪ কোটিতে পৌঁছেছিল।

শ্বেতপত্র অনুযায়ী, সক্ষমতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে উন্নত করা এবং কর্মসংস্থানের জন্য ৩০ হাজার জনবলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হয়েছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রকল্পের সফলতায় উচ্চ মাত্রার সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়।

তবে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, এই প্রকল্পে খাতের অগ্রগতিতে অবদান রাখা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা উপেক্ষা করা হয়েছে।

অতিরিক্তভাবে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের মান ছিল অপর্যাপ্ত। কারণ এটি ৩০ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে পুরো আইটি খাতে যে সীমিত প্রভাব পড়েছে, তা সঠিকভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়নে এই বিশ্লেষণমূলক দুর্বলতা বিভিন্ন আইসিটি এবং অন্যান্য প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে, যেগুলো বাস্তবিক উপকারিতা প্রদানে অক্ষম।

শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, এটি ভবিষ্যৎ উদ্যোগগুলোকে আইটি খাতের ওপর তাদের প্রকৃত অবদানের পরিষ্কার ধারণার ভিত্তিতে পরিচালিত করার জন্য আরও শক্তিশালী মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

ডিজিটাল ও স্মার্ট জাতি গঠনের বর্ণনার পরও বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত সূচকের অনেক ক্ষেত্রে তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কেনাকাটার ক্ষেত্রে একটা বড় দুর্নীতি হয়েছে। আর একটি বিষয় হলো অনেক প্রকল্প বা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করার কথা বলে আরও বড় অঙ্কের প্রকল্প করা হয়েছে যে গুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটাও যাচাই বাছাই করা হয়নি।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা তো রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা এবং এর পাশাপাশি আবার পরিবারতন্ত্র যুক্ত হয়ে বিষয়টি একেবারে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। 

পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, কিছু কিছু প্রকল্প থাকবে যেগুলো চালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এবং কিছু কিছু প্রকল্প যেগুলো প্রয়োজন নেই সেগুলো অন্য খাতে যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে অবকাঠামো বা বিনিয়োগের সুযোগ থাকতে পারে।

আইসিটি খাতে দুর্নীতি ও অপচয় রোধে সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়