কে কোন ‘মওকা’ খোঁজে ব্যতিক্রমই বটে!
ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত হেরে গেলো। তাতে আমার খুশি খুশি লাগে কেন? ভারত হেরে গেলে একসময় কষ্ট পেয়েছি। মন খারাপ হয়েছে। আজ তবে মনটা হঠাৎ গোঁ ধরে কি গোত্তা খেলো? বিষয়টি খুব ভাবনার বটে। ক্রিকেট-বাণিজ্যের জাতীয়তাবাদী ফুয়েল কি তাহলে আমার ট্যাংকিতেও টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে? খুব ভালো করে খেয়াল করলাম, মোটেই তা নয়।
এক ভয়ানক দৈত্যাকার অনাচারী পদক্ষেপ টলে যাওয়ায় এই আনন্দ। নিজেকে কোনোমতেই দোষ কিংবা কৃতিত্ব- কোনোটাই দিতে যাচ্ছি না। কারণ এই আনন্দের প্রবণতা আমার একার নয়। এ আমার মাটি আর ভাষায় পাওয়া উত্তরাধিকার। অন্যায় দম্ভের শক্তিশালী হাতের থাবায় বরাবরই সে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু ঠিক সেখানটাতেই প্রতিবাদী হয়েছে। কারা এমন? বাঙালি।
ভৌগলিক ভাগ-বাটোয়ারা যাই থাক, এই প্রবণতা বাঙালির আছে। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট অদ্ভূতভাবে বাইশ-গজি মাঠটাকে এনে হাজির করেছে আমাদের মাঝখানে। তাই কি? মনে হয় একটু ভুল হলো। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসলে দাঁড় করায়নি। দাঁড় করিয়েছে অন্যকিছু। কী সেটা? কেনো হঠাৎ করেই খেলারও অনেক আগে থেকে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচটা একটা তপ্ত নিঃশ্বাসের ঘেরাটোপে পড়ে গেলো? পেছনে ফিরে একটু দেখা যাক।
ফেসবুকে খেলার আগে ‘ভেন্যু বদল’ নিয়ে খানিক হৈ চৈ-এর চেষ্টা চললেও তা দিনে দিনেই চাপা পড়ে যায়। অর্থ্যাৎ ফোঁসফোঁসানির খোরাক হিসেবে এটি তেমন একটা চলেনি। তবে চলেছে অন্য একটা খোরাক, যেটিকে কেন্দ্র করে ম্যাচের আগেই বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট খেলায় একটা আলাদা উত্তাপ তৈরি হয়। আমার বিবেচনায়, স্রেফ একটি ম্যাচ নিয়ে কচলানি নয়, বরং আমাদের বোঝা দরকার, ওই খোরাকটিকেই, যেটি নিঃসারে এসে আপন কাজটি করে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো। কিন্তু তুলে দিলো এমন এক ঘূর্ণি, যা অনেককিছুই বদলে দিলো।
খোরাকটা স্রেফ এক ফানি ভিডিও ‘মওকা’। কী আছে ওতে? লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, মওকা সিরিজের অনেক ভিডিওই দেখেছি। কিন্তু আলোচ্য খোরাকটির মতো জাতীয়তাবাদের আগুন উস্কানো কাণ্ড আর কোনোটাতেই ছিল না। বাংলাদেশের সমর্থক পেপেসিখেকো এক ভারতীয় সমর্থককে মওকা জানাতে গেলেন। এরপর সেই ভারতীয় সমর্থক ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন, ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশের মানচিত্রটাকে, যেখানে মূল ইঙ্গিতটা রইলো, ১৯৭১-কে ঘিরে। বাংলাদেশে আজো স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের কাজ করে যায়, তা প্রতিরোধের চেষ্টাও চলে। কিন্তু এর চেয়েও বড় সত্য, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই একটা রাজনৈতিক দল এদেশে রেকর্ড জয় পায় ভোটে। কাজেই একাত্তর আমাদের কাছে আবেগের যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে ঘিরে এমন ইঙ্গিত যা ঘটাতে পারে, তাই ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার সমস্ত কৃতজ্ঞতা আমরা আজও স্বীকার করি। কিন্তু এই ভিডিওটা সহ্য করা যায় না। এর ভাষা ছিল এমন, একাত্তরে আমরা (ভারত) দয়া করে তোদের বাঁচিয়েছি; আজ তোরা আমাকে (ভারত) বাপ মান!
আমার বিবেচনায় এই ভিডিওটির প্রভাব যতোটা সুদূরপ্রসারী, স্রেফ ম্যাচের ফলাফলে তা সম্ভব হতো না। কিন্তু কারা বানালো সেই ভিডিও? তারা কোথায়? কী উদ্দেশ্য ছিলো তাদের? ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি, আমার পরিচিত ভারতের অনেক বাঙালি বন্ধু ওই ভিডিওটির বিপরীতে অবস্থান করেন। তাঁরা কি একটু এই প্রশ্ন নিয়ে খুঁজে দেখবেন, ভিডিও-ওয়ালার ধান্দা আসলে কী ছিল?
একাত্তর কেনো এতো বেশি আবেগের জায়গা, তা ভারতের বাঙালি বন্ধুদের অনেকেই জানেন। তাঁরা অনুভবও করেন। কিন্তু এ কি শুধুই আবেগ? যদি বলি, বিশ্বের জন্য এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটির মধ্যে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের রাজনীতির বিরুদ্ধে একমাত্র বিপরীত স্রোতে জেগে ওঠা রাষ্ট্র বাংলাদেশ? আলবৎ এই রাজনীতি এক বড় ক্যানভাসেই ভাবতে শিখতে হবে। আজকের ভারত আর আজকের পাকিস্তান- আজও সেই সাতচল্লিশেরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যে সেই ধারাবাহিকতার মূলে এক কুঠারাঘাতে জন্ম নিয়েছে।
আমরা প্রাণ দিয়ে, মান দিয়ে শুধু ভাষা, রাষ্ট্র আর পতাকাই অর্জন করিনি, পুরো বিশ্বটাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি, ১৯৪৭ ছিল স্রেফ এক ধান্দাবাজি। দ্বিজাতিতত্ত্বের যে নড়বড়ে ভিত্তি ব্রিটিশদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠা কুলীন রাজনীতিকরা গড়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাকে নির্দ্বিধায় বুড়ো আঙুল দেখিয়েছি আমরাই। সেই একাত্তরে। বড়টাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ছোট করার যে খায়েস, তার যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলো দুপাড় থেকেই শেকড় ছেড়ে যে দলে দলে অচেনা এক জগতে পরবাসী হলো, নিঃসঙ্গ হলো, বন্ধুহীন হলো, সেই শোষণের আর বিভাজনের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক চিৎকার। সাতচল্লিশের ধারাবাহিকতায় আজো যেখানে যেখানে শোষণ আর বঞ্চনার ছায়া ঘিরে থাকে, একাত্তর তাদের জন্যই প্রেরণা। স্পষ্ট কথা, সেই একাত্তরকে দয়া-দাক্ষিণ্যের ভিত্তিভূমি ধরে যারা ভিডিও ছেড়ে মওকা খোঁজে, তারা প্রকৃতপক্ষে কোন মওকাটা খুঁজছে, তা বোঝা জরুরি। তারা ভারতীয় হতে পারেন, তবে সম্ভবতঃ বাঙালি নন।
২. কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধু ‘ভারত-বিরোধী’ ভাইরাস নিয়ে কথা তুলেছেন ফেসবুকে। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। স্রেফ একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বর্ধমান থেকে শুরু করে সারদা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে সব খবর এসেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে গুটিকয় লোককে দায়ী করা হলেও বাংলাদেশ থেকে কখনো ঢালাও মন্তব্য আমরাই বরদাস্ত করিনি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, মওকা ভিডিওটি এবার সেই মানুষগুলোকেও কেমন বিরূপ করে ছেড়েছে। তাহলে ভাইরাস কি ‘ভারত-বিরোধী’, নাকি শেষাবধি ‘বাঙালি-বিভাজন’?
ভিডিও যারাই ছাড়ুক, শেষতক ফেসবুকে কথার খেয়োখেয়ি এক বাঙালির সঙ্গে আরেক বাঙালিরই হচ্ছে। যারা ভিন দেশের ক্রিকেট দলে সৌরভ গাঙ্গুলি নামের এক বাঙালি স্থান না পেলে উচ্চকিত হয়েছিল, সেই বাঙালির সঙ্গে বিতণ্ডা চলছে সেই বাঙালির, যারা ভিন দেশের বাঙালি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিজেদের ঘরের ছেলে বলেছিল। তাহলে কি এই ‘মওকা’ এই বিতণ্ডা পয়দা করারই ‘মওকা’? বাঙালি জাতীয়তাবাদের কফিনে কি পেরেকটা ঠুকে দেয়ার জন্যই এই মওকা? স্বাধীনতার পরে বারবার বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদ অখণ্ড ভারতের জন্য হুমকি নয়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির ধারপাশ দিয়েও না যাওয়ার কথা বারেবারে এসেছিল কেনো, তা বোঝার ‘মওকা’ কিন্তু আমাদের অনেক আগেই এসেছে। তারপরেও সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবর খুঁড়তে চেষ্টাতো আর কম হয় নি! সেই চেষ্টার চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে যারা নতুন ‘মওকা’র পালে হাওয়া দিতে চান, আর যাই হোক, আমি নিশ্চিৎ, তাঁরাও ব্যর্থই হবেন। কারণ ঝলমলে সোডিয়াম আলোর রোশনাই রঙ বদলাতে পারে, বঞ্চনার ক্ষত নয়। ফারাক্কাকে স্রেফ বাংলাদেশের ইস্যু বানিয়ে হয়তো রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু কালের আবর্তে সেই রাজনীতিও ঘোমটা খুলেছে, যখন কলকাতা বন্দর জলের অভাবে খাবি খাচ্ছে আর অন্য কোথাও গঙ্গার জল নালা কেটে নিয়ে আম উৎপাদন হচ্ছে। ‘মওকা’ রাজনীতিকে নাঙ্গা করতে কি আমাদের অতো সময় নিতে হবে? বোধহয় না। শ্রীনিবাসন আর শরদ পাওয়ারের ‘পাওয়ার গেম’ হয়তো একটু টুইস্ট দেবে। কিন্তু আরেকজন সৌরভকে ভারতীয় দলে পেতে শেষতক প্রতীক্ষা করতেই হবে যে!
৩. নতুন আলোচ্য রূপমের স্ট্যাটাস। ফসিলস- এর রূপম। আমি নিজে তাঁর স্ট্যাটাসটা দেখতে পাইনি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তিনি সেটা মুছে ফেলেছেন। স্ট্যাটাসে অন্যকিছু নয়, শুধু একটা অংশেই আপত্তি উঠেছে, বাংলাদেশকে তিনি আরেক পাকিস্তান হিসেবে দেখেছেন। যে কারণে ‘মওকা ভিডিও’ সহ্য হয়নি, সেই একই কারণে এই মন্তব্যও এদেশের মানুষের জন্য মেনে নেয়া কষ্টকর হবে। যাদবপুরে কলরবকে সুর দেয়ার আগে রূপম কোথায় ছিলেন জানি না।
তবে এদেশের বেশ ক’জন ছেলেমেয়েকে আমি চিনি, যারা সেই শুরু থেকেই বলেছিলেন ‘হোক কলরব’। যাহোক এসব কথা না তুলি। রূপমকে শুধু বলি, কলরব করে ‘পেটে পেটে কূটবুদ্ধি এঁটে মিশতে এলে যাও তফাত...’ বলেছিলেন যখন, তখন নিশ্চয় কূটবুদ্ধি নিয়ে যারা মিশতে আসে, তাদের থেকে দূরে থাকাকে আপনিও সমর্থন করবেন!
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএইচকে