গৌতম ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি
প্রিয় গৌতম ভট্টাচার্য, গণমাধ্যমে কাজ শুরুর অনেক আগে থেকেই আপনার লেখা আমার ভীষণ প্রিয়। কাজ শুরুর পরেও তাই। এককালে এখনকার মতো অনলাইনের যুগ ছিলো না। কদিন পরে আসা বাসি আনন্দবাজার খুঁজে প্রেসক্লাবে বসে আপনার লেখা পড়েছি।
আজকাল তো অনেক সুবিধা, হাতের নাগালেই পেয়ে যাচ্ছি সব। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়ে আজ আপনার ম্যাচ রিপোর্টটি পড়লাম। এক নয়, একাধিকবার। আপনার ক্রীড়া-রচনা নিয়ে কথা বলার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারিনি আজও। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থক হিসেবে আপনার এই ম্যাচ রিপোর্ট ‘চাপে ফেলেও একপেশে হার মাশরাফিদের’ (২০ মার্চ, ২০১৫ আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত) পাঠ পীড়াদায়কই বটে।
আম্পায়ারের যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে আমাদের আপত্তি, আপনি সেগুলোর মধ্যে একমাত্র রোহিত শর্মার ডেলিভারি নিয়ে সহমত পোষণ করেছেন। লিখেছেন, "রোহিত শর্মার ডেলিভারিটা আউট ছিল কোনও সন্দেহ নেই। ওই কোমর সমান নিচু ফুলটসকে আলিম দার কেন নো বল ডাকলেন, তিনিই জানেন। পাকিস্তানি আম্পায়ার ওইখানে এত বড় ভুল না করলে রোহিত আউট হয়ে যান ৯০ রানে। আরও ৪৭ রান কমে যায় তাঁর এবং টিমের রান থেকে। শেষ দিকে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ফুরফুরে ভাবটাও অনেক কমে যায়।"
কিন্তু তারপরেও তাতে ম্যাচের কোনো চিত্তবৈকল্য ঘটতো বলে আপনার মনে হয়নি। এরপর আপনার মনে হয়েছে বাংলাদেশি অধিনায়কই বরং আগেই ম্যাচটা ফেলে দিয়েছে মানে হেরে গেছে। আপনার মতো বিদগ্ধ একজন খেলা-লিখিয়ে যখন বলছেন, তখন বলার আর কী থাকে? তবে একটা ভয়াবহ রকমের বাজে সিদ্ধান্ত (যা কি না ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়) যে ব্যাটসম্যানকে বাঁচিয়ে দেয়, সেটার পূরণ কি স্রেফ “৪৭ রান কম হতো আর বাংলাদেশ তো হেরেছে ১০৯ রানে”-- এমন সরল সমীকরণ দিয়ে হয়?
তবু আপনি যখন করেই ফেললেন, তখন ভবিষ্যতে আমিও এমন সমীকরণ করতেই পারি! গতবছর ব্রিসবেন থেকে আপনার পাঠানো লেখায় বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে যেসব আলোচনা ছিলো, সেগুলোও ভুলে গেলাম! কারণ, অতো জটিল সমীকরণ কষে আর লাভটা কী? এ তো আপনারই দেখানো পথ! কিন্তু একটা বিষয়ে খটকা থাকছেই। আপনার কোনো এক লেখাতে পড়েছিলাম শচীন টেন্ডুলকারকে ইডেন গার্ডেনে অন্যায়ভাবে আউট ঘোষণার পর স্বয়ং সুনীল গাভাস্কার, ওয়াসিক আকরামকে অনুরোধ করেছিলেন, আউটের আবেদন তুলে নিতে। আকরাম রাজি হননি। এও তো পুরো খেলার মাঝে একটি ঘটনা বৈ কিছু নয়। তারপরেও আপনারা সেদিন কেন শিরোনাম করেছিলেন- ‘আক্রম লুজেস ইন্ডিয়া মে উইন দ্য ম্যাচ’?
অনেক লেখাতেই আপনি ক্রিকেটে এমন জেন্টলম্যানশিপের কথা তুলেছেন। আপনার একটা লেখা থেকে বরং উদ্ধৃত করি- “টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দুটো হাতেগরম নমুনা আছে আম্পায়ার আউট দেওয়ার পরেও ফিল্ডিং টিমের অধিনায়কের আবেদন তুলে নেওয়ার। বারবার যেটার চর্চা হয়ে থাকে তা হল, জুবিলি টেস্টে আউট ঘোষিত বব টেলরকে বিশ্বনাথের ডেকে নেওয়া। অন্যটা, দু’বছর আগে চা বিরতির সময় আম্পায়ার বেল তোলার আগেই হাঁটতে শুরু করে আউট ঘোষিত ইয়ান বেলকে আবেদন তুলে ধোনির মাঠে ফিরিয়ে নেওয়া। দু’বারই ভারত সৌজন্য দেখিয়েছে। অথচ তার যখন সেটা ফেরত পাওয়ার, কেউ ফিরতি সৌজন্য দেখায়নি।” তো, আজ আপনার লেখায় আপনি একটিবারের জন্যও সেই জেন্টলম্যানশিপ বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিলো বলে উল্লেখ করলেন না যে!
যাক বাদ দিন। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে হারা ম্যারাডোনার কান্নায় যে আবেগ মেশানো ছিলো, তার ব্যাখ্যা খুব সম্ভবত আপনার দুয়েকটি লেখাতেই পড়েছিলাম। হ্যাঁ, হয়তো বাংলাদেশ দল বলেই আমার এই আবেগটা বেশি। ক্রিকেট এবং বাণিজ্য-- কোথাওই এই অক্ষম আবেগের কোনো মূল্য নেই, জানি। তবে কষ্টটা কী জানেন, বাংলাদেশে বাস করি বলে শুধু নয়, এই দলটার শতভাগ বাঙালি, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন-- আবেগটা সে জন্যই অনেক বেশি আমার। ভারতের দলটার জন্য ভেতর থেকে যে কারণে একদিন সৌরভ গাঙ্গুলিকে ঘিরে আবেগ কাজ করতো। আমি বলছি না, সেই আবেগ সব বাঙালির কাজ করবে বা করাটা জরুরি। তবে আমার করছে, আমাদের অনেকরই করে।
ফারাক্কা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠার পেছনে অনেককিছুই আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বাড়ানো সমীচীন হবে না। শুধু বলি, যে ফারাক্কার কথা বলছেন, তা যে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর মুলো ঝুলিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো, সেই বন্দরটি কি এর ফলে বেঁচেছে?
খুব ভালো করে হিসেব কষলে দেখা যাবে, ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশের নয়, আসলে বাঙালিরই ক্ষতি করেছে। সীমান্তের কাঁটাতারের দুপারেই ফারাক্কার হাহাকার ছড়িয়ে আছে। প্রিয় লেখক আপনি। তাই আমার লেখার এই প্রচেষ্টার শেষটাও আপনার লেখা থেকেই উদ্ধৃত করতে চাই। শ্রীনিবাসনের কুলীনদের ক্রিকেট গোষ্ঠী করার বৈঠক নিয়ে আপনি লিখেছিলেন, “নিজের স্বল্পকালীন লাভের কথা ভাবতে গিয়ে দীর্ঘকালীনভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বনাশ করে ছাড়ছেন শ্রীনিবাসন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো একত্রিত হয়ে যে জোট তৈরি হয়েছিল সেটা এতদ্বারা তিনি শুধু ভেঙেই দেননি, প্রচণ্ড হানাহানির সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছেন। এরা কেউ আর ভারতকে বিশ্বাস করতে রাজি নয়।”
হয়তো তাই। তবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতেই চাই, ভারতীয় হিসেবে নয়, বাঙালি, তাই। আর নইলে হয়তো একটি আপনার দেয়া শিরোনাম ‘শোষণ করতে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটই না শোষিত হয়ে পড়ে’ বাস্তবায়িত হতে দেখবো। কিন্তু আপনার কথা আর মনেও পড়বে না। ভালো থাকবেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/একে