News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১৬ মে ২০২০
আপডেট: ১৫:১৫, ৭ জুলাই ২০২০

আমাদের সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র এটিএম শামসুজ্জামান

লুতফর রহমান লিটন

আমাদের সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র এটিএম শামসুজ্জামান

আমাদের সংস্কৃতির আকাশে হিরণ্ময় দ্যুতিতে দীপ্যমান নক্ষত্রপ্রতিম এটিএম শামসুজ্জামান। অভিনেতা হিসেবে এটিএম শামসুজ্জামান আমার প্রথম দৃষ্টি কেড়েছিলেন ১৯৬৮ সালে, সংলাপ বিহীন একটি চরিত্রে অভিনয় করে। চলচ্চিত্রের নাম 'এতোটুকু আশা'। নায়ক রাজ্জাক। নায়িকা সুজাতা। সেই চলচ্চিত্রে আলতাফ হোসেন একজন দরিদ্র পঙ্গুর (একটি পা এবং একটি হাত অকেজো) চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

পঙ্গু আলতাফ পত্রিকা হকার। তার কাঁধে ঝোলানো কবিদের মতো একটা ঝোলা, ঝোলায় ভাঁজ করা কয়েকটা পত্রিকা। তার সঙ্গে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে এক বাণ্ডেল পত্রিকা হাতে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি পরা রোগা-পটকা মামুলি চেহারার শিল্পী (এটিএম শামসুজ্জামান)। আলতাফ গান গাইতে গাইতে পত্রিকা ফেরি করছেন--'তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়? / দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়/ আমি তো দেখেছি কতো যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়/ শুকনো পাতার মর্মরে বাজে কতো সুর বেদনায়/আকাশে বাতাসে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়'...। তাদের ঘিরে ভিড় করে দাঁড়ানো একদল মানুষ।

আকাশে বাতাসে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়--লাইনটা আলতাফ যখন গাইছেন--পর্দায় তখন সিঙ্গেল শটের ক্লোজ একটা ইনসার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি পরা তার এসিস্ট্যান্টের। গানের মর্মার্থ অনুধাবন করে বেদনাজর্জর হৃদয় উৎসারিত কান্নার গমককে থামাতে ঠোঁট কাঁপছে সেই অভিনেতার। দর্শকদের নজর ছিলো আলতাফের দিকে তাই অধিকাংশ দর্শক খেয়ালই করলো না কী দুর্দান্ত একজন অভিনেতা আলতাফের এসিস্ট্যান্টের ভূমিকায় অভিনয় করছেন! কিন্তু আমার করোটির ভেতরে তার সেই ঠোঁট কাঁপানো দৃশ্যটা মুদ্রিত হয়ে থাকলো স্থায়ী ভাবে। কতো কিছু ভুলে গেছি কিন্তু সেটা আর ভুলতে পারিনি। সংলাপ বিহীন অনুল্লেখ্য ছোট্ট একটা চরিত্র কিন্তু তিনি অভিনেতা হিসেবে তার জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন সেই একটা দৃশ্যেই। সেই থেকে আমি তার অনুরাগী।

কিন্তু আমার মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়ে গেলো 'নয়ন মনি' চলচ্চিত্রে গ্রামের ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ টাউট মোড়ল  চরিত্রে তার অসাধারণ অভিনয় দেখে। বাংলা চলচ্চিত্রের ভিলেন চরিত্রের ধরনটাই পালটে দিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্রের স্টার আর্টিস্ট ববিতা-ফারুক-রোজী-আনোয়ার হোসেনদের পেছনে ফেলে দুর্দান্ত দাপটে সম্মুখ কাতারে এগিয়ে থাকলেন একজন এটিএম শামসুজ্জামান। 'নয়ন মনি'তে অসামান্য অভিনয়ের পাশাপাশি তার প্রক্ষেপিত দু'টো সংলাপ এই এতো বছর পরেও কান পাতলে শুনতে পাই আমি। একটি--'বাইশ গ্যারামের মোড়ল আমি'। দ্বিতীয়টি--''যতক্ষণ পর্যন্ত অই মাইয়ার বাপ-মাও কাফফারা না দ্যায় ততক্ষণ পর্যন্ত অই মাইয়ার জানাজা হবে না'।

আজ দুপুরে ফেসবুকে ঢুকেই দেখি আমার প্রীতিভাজন এক তরুণ প্রকাশক স্ট্যাটাস দিয়েছে--এটিএম শামসুজ্জামান আর নেই। সেখানে লোকজন রিপ রিপ করছে। ম্যাসেঞ্জারে সেই প্রকাশককে ধরলাম--এই খবর কই পাইলা? বললো--একজন বল ছে। আমি বললাম--জলদি ডিলিট করো মিয়া। তিনি বাঁইচা আছেন। এর আগেও বেশ কয়েকবার ফেসবুক সৈনিকরা তার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করেছে। তখনও থামিয়েছি কয়েকজনকে। এবং প্রতিবারই এটিএম শামসুজ্জামানকে এসে বলতে হয়েছে--'আমি মরি নাই! এবারও তেমনটাই ঘটলো। একই ঘটনা নায়করাজ রাজ্জাকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একাধিকবার। সবার আগে পাবলিককে জানানোর ভয়ংকর অসুস্থ একটা প্রতিযোগিতা চলে ফেসবুকে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনেও এরকম কাণ্ড ঘটতে দেখেছি নিকট অতীতে।

এই ফেসবুক রটনার পর প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথোপকথনটি ছিলো এরকম--‘মরিনি এখনো। এর আগেও ১০–১২ বার আমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে। কেন যে এ রকম করে বুঝি না। আমার সঙ্গে কিসের শক্রতা, বুঝি না। আল্লাহ এদের হেদায়েত দান করুন। তার মৃত্যুর খবর যখন রটানো হচ্ছিলো, তখন তিনি ছিলেন তার সুত্রাপুরের বাসায়। এ টি এম শামসুজ্জামানের স্ত্রী রুনি জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সন্ধ্যার পর হঠাৎ চারদিক থেকে ফোন আসা শুরু হয়। সবাই জানতে চাইছে, এ টি এম শামসুজ্জামান সাহেব কখন মারা গেছেন। আমরা রীতিমতো অবাক, দেশের এই দুর্যোগের সময় একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে মেরে ফেলতে পারে!

পারে। ফেসবুকের জাগ্রত সৈনিকরা সব পারে। আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন এটিএম শামসুজ্জামান। এটিএম শামসুজ্জামান একের পর এক মন্দ লোকের চরিত্রে অভিনয় করে করে এমন একটা ইমেজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন যে 'এটিএম শামসুজ্জামান' নামটাই বদ এবং কুটিল লোকের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো এক পর্যায়ে। এমনকি আমি কানাডায় থিতু হবার পরেও, টরন্টোর এক সাংবাদিক বন্ধু আমাদের আরেক কবি বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে অতি স্বতঃস্ফূর্ততায় বলেছিলেন--'এটিম শামসুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হলো বিকেলে!' আমিও সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গিয়েছিলাম তিনি কার কথা বলছেন! হাহ হাহ হাহ।

২০১৩ বা ১৪ সালে আমি বাংলাদেশে অবস্থানের সময়টায় এক বিকেলে গণভবনে একদল অভিনয় শিল্পী-কণ্ঠশিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-কবিকে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোটামুটি বিশাল একটা সমাবেশ ছিলো সেটা। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে এটিএম শামসুজ্জামান খানও ছিলেন। ব্যাক ইয়ার্ডের বিশাল চত্বরের সবুজ ঘাসের বুকে নক্ষত্রের মেলা বসেছিলো যেনো। এক পর্যায়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি একজনের উদ্দেশ্যে আর উল্টোদিক থেকে আসছেন এটিএম। আমরা মুখোমুখি হতেই আমি একটা হাত বাড়িয়ে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করার আকাঙ্ক্ষায় বললাম, আমার নাম...। বাক্য শেষ করার আগেই তিনি আমার দু'টি হাত জড়িয়ে ধরে খুবই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন--'ইউ আর এ গ্রেট ম্যান।' শুনে আমার তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার যোগাড় -কী বলছেন শামসুজ্জামান ভাই! -হ্যাঁ, আপনি যে লুৎফর রহমান রিটন সেটা আমাকে বলে দিতে হবে! বাংলাদেশে থাকি আর আমি আমাদের রিটনকে চিনবো না! এরপর একটা দীর্ঘ আলিঙ্গনে বেঁধেছিলেন তিনি আমাকে।

তাকে নিয়ে আমি আমার এক জীবনের মুগ্ধতার কথা পুরোটা বলতেই পারলাম না। তার আগেই তাকে ছোঁ মেরে কেউ একজন নিয়ে গেলেন। এর পরের বছরেই আবার দ্বিতীয়বার সামনা সামনি দেখা হলো আমার, প্রিয় শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামানের সঙ্গে। স্থান ওসমানী মিলনায়তন। সময়কাল ২০১৫। সে বছর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন সাগর ভাই মানে ফরিদুর রেজা সাগর। পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়