News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ৭ মে ২০২০
আপডেট: ০৪:২৩, ১১ জুন ২০২০

আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা পলটিশিয়ান

আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা পলটিশিয়ান

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তাঁর এক বক্তৃতায় ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন।তিনি একদিন ঢাকা কলেজে ক্লাস নিচ্ছিলেন আর পাশেই 'লড়াই লড়াই লড়াই চাই,লড়াই করে বাঁচতে চাই' স্লোগান দিতে দিতে একটা মিছিল যাচ্ছিল।স্যার বলেন,ঐ সময় ক্লাসের একজন ছাত্র একরকম তাচ্ছিল্যের সুরেই স্যারকে বললো 'দেখেন স্যার লড়াই করে বাঁচতে চায়।কেন যে এরা কলেজে আসে!' স্যার ঐ ছাত্রের প্রতিউত্তরে বলেছিলেন- 'দেখো আমিতো তোমাদেরও চিনি,ওদের ও চিনি।যদি বুদ্ধির কথা বলো,তবে আমি বলবো তাদের বুদ্ধি তোমাদের থেকে সাত গুণ বেশি।ওরা তোমাদের সাতবার বিক্রি করে সাত বার কিনে ফেলতে পারবে।আর সাহসের কথা কি বলবো?তোমরা যখন কিছু নম্বরের জন্য আমার কাছে কাচুমাচু করে বসে আছো তারা সেই সময়টায় অধিকার আদায়ের জন্যে স্লোগান দিচ্ছে।তোমরা তোমাদের কাজ করছো আর তারা তাদের টা।তোমরা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে একদিন সেক্রেটারি হবে,আর এই ছেলেগুলোও ধীরে ধীরে রাজনীতি করতে করতে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী হবে।আর সেদিন তোমাকে বলতে হবে আসসালামু আলাইকুম স্যার।'

স্যার যে সময়টার গল্প বলছিলেন তখন ছিলো ছাত্র রাজনীতির সোনালী এবং উত্তাল সময়।সেই সময়টায় ছাত্ররাজনীতির অর্জনের ঝুড়ি ছিলো পরিপূর্ণ।৫২'র ভাষা আন্দোলন,৬২'র শিক্ষা আন্দোলন,৬৯'র গনঅভ্যুত্থান,৭০'র নির্বাচন কোথায় ছাত্রদের অবদান ছিলোনা।আর মহান মুক্তিযুদ্ধেতো শুধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগেরই প্রায় ১৭ হাজার নেতা কর্মী দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলো।সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্ররাজনীতির এত এত অর্জন থাকার পরও মানুষ সে সময় ছাত্ররাজনীতিকে বাঁকা চোখে দেখতো।আর বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতো আমাদের অজানা নয়।

বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি করা ছেলেগুলোকে নিয়ে মানুষের উপলব্ধি হলো এরা জীবন নিয়ে উদাসীন এবং সাময়িক ক্ষমতার লোভে আচ্ছন্ন।কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা একজন হিসেবে এরকম উপলব্ধি আমার কখনোই হয়নি।স্যারের মত আমারও মনে হয় দেশাত্মবোধ, মনুষ্যত্বের চর্চা করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলার রগ ফুলিয়ে হুংকার করে উঠা,যেকোন পরিস্থিতিতে ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকা,প্রগতিশীলতাকে ধারণ করা আর সময়ের সাহসী ছেলেগুলোই ছাত্ররাজনীতিতে আসে।

যে দেশের ভাষার অধিকারের সংগ্রাম,স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামসহ সকল স্বাধীকার আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির অবদান অনস্বীকার্য সে দেশের মানুষ এতটা ছাত্ররাজনীতি বিমুখ কেন হবে?

প্রথমত, আমার মনে হয় রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথ ছাত্ররাজনীতি বিমুখতার কারণ।একটা ছেলে জীবনের শুরুতেই এরকম ঝুঁকিপূর্ণ,অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়াবে এটা কেউ চাইবেনা।যেখানে ভালোভাবে পড়াশোনা করে কর্মজীবনে সফল হয়ে জীবন উপভোগ করবে তার বিপরীতে একজন ছাত্র নিজেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলাকে অনেকেই সমীচীন মনে করেনা।

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা,আদর্শের জায়গা থেকে বিচ্যুতি,ছাত্রসমাজের­ প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা,দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এই জায়গাগুলো থেকে দূরে চলে আসার অভিযোগ।

এবং তৃতীয়ত,কিছু মানুষ বরাবরই ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করে আসা।

প্রথম ব্যাপারটা আমি কোন সমস্যা দেখিনা।রাজনীতির পথ অনিশ্চিত এবং কঠিন।জীবনের শুরুতে একজন ছেলে নিজেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলবে এটা অনেকেই সমর্থন করবেনা।

দ্বিতীয় পেয়েন্টের কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলা শুরু হয়েছে ৯০'র দশকের শুরু থেকে।এটা অস্বীকার করারর কোন সুযোগ আমাদের নাই যে বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে এই ব্যাপারগলো একদমই ঘটছেনা।কিন্তু আবু সায়ীদ স্যার যে গল্পটা বলেছেন সেটা ৭০'র দশকের শেষের দিকের ঘটনা।যে সময়টাতে ছাত্ররাজনীতির অর্জনের ঝুড়ি ছিলো পরিপূর্ণ।সে সময়টায় দেশের প্রতি,ছাত্রসমাজের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রনেতারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো।তাহলে কেন সে সময়টাও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এতটা রাজনীতি বিমুখ হবে!আমার মনে হয় এই ব্যাপারটার সাথে তৃতীয় পয়েন্টের কিছুটা যোগসাজশ রয়েছে।এরকম প্রতিটি প্রজন্মেই একটি গোষ্ঠী বা দল ছিলো যারা ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করেছে এবং করছে।এরা শুধুমাত্র ছাত্ররাজনীতির বিচ্ছন্ন ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে এসে ইস্যু তৈরি করে।যার প্রভাব ছাত্রদের উপর প্রবলভাবে পড়ে।তারা ছাত্ররাজনীতির অপ্রয়োজনীয়তা বুঝাতে ইউরোপ,আমেরিকার উদাহরণ টেনে নিয়ে আসে।আমি তাদের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই,এটা ঠিক যে সেসব দেশে ছাত্ররাজনীতি নেই,কিন্তু এটাও সত্যি আমাদের মত ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাসও তাদের নেই।আর তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফারাক টা আকাশ-পাতাল।আমি সে দিকটায় এখন আর গেলাম না।যে গোষ্ঠী ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে আওয়াজ তুলেন সেই তারাই আবার জাতীয় রাজনীতিতে সৎ এবং নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব খুঁজেন।কিন্তু এরকম চাওয়াটা একরম আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনার মত।কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই আছে যারা ছাত্ররাজনীতি করে আসবেন তারাই একসময় জাতীয় রাজনীতিতে আসীন হবেন।তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম কিছু উদাহরণ আছে।এই যায়গাটাতেই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈপরীত্য।আমাদের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনভাবেই রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবেনা।এখন কথা হচ্ছে এই যে প্রতিনিয়ত ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে আওয়াজ তুলে এক একটা প্রজন্মকে রাজনীতি বিমুখ করে ফেলা হচ্ছে এতে লাভটা কি?

এতে হয়তো আমরা কিছু শিক্ষিত,উচ্চ শিক্ষিত লোকবল পাচ্ছি এটা যেমন ঠিক আবার এই শিক্ষিত অংশটাই রাজনীতিকে অনেকটা বাঁকা চোখে দেখবে এটাও তেমনি ঠিক।আলটিমেট হিসেবটা করতে গেলে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় এতে লাভের চেয়ে অনেক গুন বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের।কারণ দেশের মেধাবী অংশটাকে আমরা দেশ পরিচালনা থেকে সরিয়ে দিয়েছি।আমি আপনি যত কথাই বলি আর যত সমালোচনাই করি, দেশ পরিচালনা কিন্তু রাজনীতিবীদরাই করেন।

সব ছাত্র অথবা সব মেধাবীদেরই রাজনীতি করতে হবে আমি এমনটা বলছি না।আমি বলতে চাই,মেধাবীদের একটা অংশ বিজ্ঞানী,ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যান্য পেশায় যাবে।আরেকটা অংশকে অবশ্যই রাজনীতিতে আসা উচিত।তাহলে দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেধাবীদের অংশগ্রহণ থাকবে।এখানেও আবু সায়ীদ স্যারের গল্পের শেষের অংশটুকু বলতে চাই।স্যারের ক্লাসরুমে বসা মেধাবীরা যখন পদোন্নতি পেয়ে সচিব হবে ঠিক সে সময়টায় তাদের সাথে রাজনীতি করা ছেলেদের কেউ কেউ ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ধাপ পার হয়ে কোন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পাবে।একটা মন্ত্রণালয়ে সব নীতিগত সিদ্ধান্ত একজন মন্ত্রী নেয়।আর সচিব শুধু সেটা কার্যকর করে।আজকে যদি মেধাবী ছেলেটা নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতো তাহলে আজ সে নীতিনির্ধারণী জায়গায় থাকতো।তার সৎ,সঠিক এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে অবশ্যই দেশ উপকৃত হতো।তার থেকে জাতি আবশ্যই আরো ভালো কিছু পেতো।

আমরা স্বীকার করি বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে।কিন্তু মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলে দেওয়া এটা কোন সমাধান নয়।সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।যে সমস্যাগুলো আমাদের বর্ণীল ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করেছে সেগুলোকে খুঁজে বের করে সমাধানের পথ বের করতে হবে।কিন্তু ছাত্ররাজনীতি বন্ধই করে দিতে হবে আমি এটা কোন ভাবেই সমর্থন করবো না।কারণ একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের বয়স অবশ্যই আঠারো বছর।আঠারো বছর বয়সের একজন ছাত্র যদি নিজের ভোটারাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তাহলে সে কেনো রাজনীতি করতে পারবেনা?সে যদি চায় রাজনীতি করতে তাহলে তাকে অবশ্যই রাজনীতি করতে দিতে হবে এবং তার সাথে তাকে উৎসাহ দিতে হবে।

ছাত্র রাজনীতি করলেই কেউ রসাতলে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।১৯৮০ সালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে দশদিন তিহার জেলে ছিলেন অভিজিৎ বন্দোপধ্যায়।সেই অভিজিৎ বন্দোপধ্যায়ই ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান।বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি নইমুদ্দিন আহমেদ পরবর্তীতে পেশা জীবনে আপিল বিভাগের বিচারক হয়েছিলেন।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা,সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।এছাড়াও ছাত্রজীবনে রাজনীতি করা এরকম অনেকে আছেন যারা পরবর্তীতে নিজ নিজ পেশায় সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়েছেন।বরং ছাত্রজীবনে রাজনীতি করা ছেলেগুলো পরবর্তীতে পেশাগত জায়গায় গিয়েও নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকেন।

একটি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি এবং ভরসার জায়গা তাদের তরুণ প্রজন্ম।তরুণরা উদ্যমী,তরুণরা স্ফুলিঙ্গ,তরুনরা বেপরোয়া,এই তরুণরাই রক্তজবা আবার তারাই ফুটন্ত গোলাপ।কবি সুকান্ত 'আঠারো বছর' কবিতায় বলেছেন- "আঠারো বছর বয়সেই অহরহ, বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।" আঠারোর দুঃসাহসী,বেপরোয়া এই তরুণদেরই প্রয়োজন আমাদের ছাত্ররাজনীতিতে।কোন অন্যায়কেই পরোয়া করবেনা এই বেপরোয়ার দল।সকল অনিষ্ট পদদলিত হবে দুঃসাহসিক এই প্রজন্মের কাছে।এই তরুণরা মানুষের ভালবাসায় ফুটন্ত গোলাপ যেমন হবে ঠিক অন্যায়ের প্রতিবাদে রক্তজবা হবে।সময়ের মেধাবী আর সাহসী এই সন্তানরাই বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব দিবে।তাদের হাত ধরেই আমাদের ছাত্ররাজনীতি তার সোনালী অতিতের ছোঁয়া পাবে।তাদের পদচারণায় জাতীয় রাজনীতি পাবে একঝাঁক অদম্য,সৎ,সাহসী এবং প্রগতিশীল নেতৃত্ব।রাজনীতিআর রাজনীতিবিদদের নিয়ে মানুষের ধারণার আমূল পরিবর্তন আসবে তাদের নেতৃত্বগুণে।আর আগামীর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম তাদের এইম ইন লাইফে ডাক্তার,সায়েন্টিস্ট,ইঞ্জিয়ারেরপাশাপাশি লিখবে 'আই ওয়ান্ট টু বি এ পলিটিশিয়ান'।

 

লেখক: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন কর্মী।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়