জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দে
এত সুর আর এত গান, যদি কোন দিন থেমে যায় সেই দিন তুমিওতো ওগো জানি ভুলে যাবে যে আমায়। ডেকোনা আমাকে তুমি কাছে ডেকো না, দূরে আছি সেই ভালো নিয়ে বেদনা। গত কয়েক দশক ধরে এরকম অসংখ্য গান গেয়ে হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে মানুষকে গান শুনিয়ে রোজগার করে আসছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দে।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বাংড়া ইউনিয়নের উত্তর বাগুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয় লাভ করলেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
ঠিক তার গানের কথার মতো তার সুর যেন থেমে যাচ্ছে, একসময় গান গেয়ে সংসার চালালেও বেশি বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর পারছেন না।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান, থাকেন সরকারের কাছ থেকে পাওয়া বীর নিবাসে। কিন্তু চির অভাবের সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর থাকে না তেমন কিছু। এই আশি বছর বয়সেও তাই মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন আসে পাশের মানুষদের গান শুনিয়ে পাঁচ-দশ টাকা পাওয়ার আশায়। কেউ যদি দয়া করে অসুখের জন্য দুটো ট্যাবলেট কিনে দেয়।
স্বাধীনতার ৫০ তম বছরে পা রাখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং যুদ্ধ পরবর্তী ঠিক এই সময়ে কেমন চলছে তার জীবন যাপন তা জানতে বিভিন্ন বিষয়া নিয়ে কথা হয় তার সাথে।
তিনি বলেন, “আমার জন্ম ময়মনসিংহ শহরে। আমি ছিলাম অসচ্ছল বাবার ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড়। সংসারের অভাব-অনটনের পড়ালেখা তেমন করা হয়ে ওঠেনি। তরুন বয়স থেকেই গান শুনতে ও গাইতে ভাল লাগতো। আমি নাটকের দলে গান করতাম, বাঁশি বাজাতাম। তা থেকে দু-চার পয়সা আয়ও হতো।”
একাত্তরে পাকিস্তানীরা দেশের মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। শহর থেকে অত্যাচার গ্রামেও ছড়িয়ে পড়লো। কত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে, নারীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছে। মানুষ ভয়ে তখন বাড়ি-ঘর ছাইড়া কেউ জঙ্গলে কেউ গর্ত খুড়ে পালিয়ে থেকেছে।
এসব শুনে মনে বড় রাগ জন্মে দিলীপের এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে সে। পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চলে যায় ভারতের মেঘালয়ে ট্রেনিং নিতে। ট্রেনিং শেষে অংশ নেয় যুদ্ধে।
”আমি ছিলাম ১১ নাম্বার সেক্টরে। যুদ্ধ করেছি জামালপুরের বকসিগঞ্জ এবং কামালপুর বর্ডারে। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আফছার আর আমার কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল আবু তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসুল হাসান বেল্লাল।তখন আমাদের মনে কোন ভয় কাজ করে নাই। আমাদের সংকল্প ছিল যে করেই হোক হানাদার বাহিনীকে ধ্বংস করতে হবে, না হলে ওরা এই দেশটাকে ধ্বংস করে দেবে।”
দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পর পরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে টাঙ্গাইলের কালিহাতী বেড়াতে আসে দিলীপ। এলাকাটা ভাল লেগে গিয়েছিল, মানুষদেরও আর তাইতো পরে বাগুটিয়া গ্রামে বিয়ে করে থেকে যায় এখানেই। তবে অভাব তার পিছু ছাড়েনি কখনো। গান গেয়েই সংসার চালাতে হয়েছে। মাঝে মাঝে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে অনাহারেও থাকতে হয়েছে ।
পরে অনেক কষ্টে বোন এবং মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছে দিলীপ তবে অভাবের কারণে ছেলে দুটোকে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। ওদেরও এখন সংসার হয়েছে। একজন একটি সেলুনে কাজ করে, আরেকজন অন্যের সিএনজি চালায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা চালুর শুরু থেকেই দিলীপ তা পেয়ে আসছে। তিনশ টাকা থেকে শুরু হয়েছিল আর এখন সেই ভাতা বারো হাজার টাকা। তবে সংসারের প্রয়োজনে করা ধারের টাকা শোধ করতেই তার অনেকটা চলে যায়। সরকার দিলীপকে একটা ঘরও দিয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ দিলীপ।
“যুদ্ধের সময় এত মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। এখন এত মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে হলো সেটা আমি জানিনা। শুনেছি অনেক মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মেয়েরা সরকারি চাকরি পেয়েছে। আমিতো আমার ছেলে দুটোকে একটা পিয়ন-দাড়োয়ানের চাকরিও নিয়ে দিয়ে যেতে পারলাম না। ওদের অভাবের সংসার। তারপরও গত জৈষ্ঠ মাসে আমার স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে ওরাই আমাকে দেখাশোনা করে।”
“বঙ্গবন্ধুর একটা কথা আমার খুব ভাল লাগতো। তিনি সবসময় বলতেন আমার সোনার বাংলা। আমাদের দেশটা সত্যি সোনার বাংলাই তো। বঙ্গবন্ধু দেশটা স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে মানুষ সুখে শান্তিতে থাকবে এটাই তো হবার কথা। কিন্তু শুধু মানুষের স্বভাবের কারণে দেশটা নষ্ট হয়ে গেল। এখন দেশের মানুষের মধ্যে না আছে একতা না আছে ন্যয়নীতি। শুধু হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানি।“
”আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। দেশের জন্য আমার মায়া আছে। এখন আনেক বয়স হয়ে গেছে। শরীরটাও অসুস্থ। সামান্য টাকায় সংসার চলেনা। ঠিকমতো একটু ভালো খাবার, ওষুধ, একটু ভালো পথ্যও খেতে পারি না। তারপরও আমি চাই ভাল থাকুক আমার দেশ। সুখে-শান্তিতে থাকুক আমার দেশের মানুষ।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি