৫ বছর পর চালু হচ্ছে রংপুর চিনিকল, এলাকায় খুশির বন্যা
ছবি: নিউজবাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারখানা আধুনিকায়নের কথা বলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষিত রংপুর চিনিকল পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ খবরে এলাকায় বইছে খুশির বন্যা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত জেলার একমাত্র কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প-কারখানা রংপুর চিনিকল।
লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫ টির মধ্যে যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম এ চিনিকলটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-২) বরাবর পাঠানো হয়। এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার আখচাষিসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করে। এ জনপদের মানুষ নতুন করে দেখতে শুরু করেছেন সুদিনের স্বপ্ন।
রংপুর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষিসহ এলাকার লোকজনের অভিযোগ, ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াই ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে আখ রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে মাড়াই বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিক্ষুব্ধ আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন।
তারা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে সব চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম এই রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি গত পাঁচ বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি,যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নিয়েছে চলমান অন্য চিনিকলে।
এ চিনিকল থেকে কাজ হারানো 'কাজ নাই, মজুরি নাই' চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিক এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিক্সা চালানোসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ৯০ এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়ণের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামী গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর।
রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫শ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্বব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত চার বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চতুর ভরে গেছে জঙ্গলে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গোচারণ ভূমি।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণ কাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির এ কর্মজজ্ঞ। ৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। পশ্চিম জার্মানির বাকাউ উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। পরে ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সকল চিনিকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি আখ ক্রয়কেন্দ্র ও ৮টি সাবজোন। এছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ১৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান সূজা বলেন, 'বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি চালু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা খুই বাস্তবসম্মত। আমরা একে স্বাগত জানাই।'
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান বলেন, 'রংপুর চিনিকলসহ মাড়াই স্থগিতকৃত ছয়টি চিনিকল পুনরায় চালুর বিষয়টি আমিও শুনেছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই চিনিকলটি চালু হলে অবশ্যই লাভজনক অবস্থায় উন্নীত হবে। কারণ এখানকার মাটি ও পরিবেশ আখ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।'
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি