বগুড়ার দইয়ের ঐতিহ্য আড়াই শ বছরের
বগুড়া: ভোজন রসিকদের পেটপুরে খাওয়ানোর পরও যে জিনিসটি না দিলে খাওয়া অসম্পূর্ণই থেকে যায়, এক নামেই তাকে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মানুষ জানে। আর সেটি হলো বগুড়ার দই। বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি সুবিদিত। দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে যদি কেউ উত্তরবঙ্গ মহাসড়ক হয়ে যায় তবে তার হাতে আর কিছু না থাকলেও একটি দইয়ের ভাঁড় থাকেই। অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের মেহমানদারিতে বহুকাল ধরেই বগুড়ার দই একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
বগুড়ার দই তৈরীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। তবে একদিন যে সনাতন ঘোষ সম্প্রদায় এই দই তৈরী করে বগুড়াকে দেশের আনাচে-কানাচে পরিচিত করে তুলেছিল, এখন সেই ঘোষদের হাতে আর দইয়ের বাজার নেই। এটি এখন চলে গেছে মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়ার শেরপুরে প্রথম দই তৈরী হয় প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে। তৎকালীন বগুড়ার শেরপুরের ঘোষ পরিবারের ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরী শুরু করেন। টক দই তৈরী থেকে বংশ পরম্পরায় তা চিনিপাতা (মিষ্টি) দইয়ে রূপান্তরিত হয়। আর কালের বিবর্তনে স্বাদের বৈপরিত্যের কারণে দইয়ের বহুমুখী ব্যবহারও শুরু হয়। টক দইয়ে যেমন মেজবানের রান্না হয়, তেমনি তৈরী হয় ঘোল। আর মিষ্টি দইয়ে চলে অতিথি আপ্যায়ন।
প্রায় আড়াইশ’বছরের পুরোনো ইতিহাস হলেও বগুড়ার দইয়ের স্বর্ণযুগ ছিল স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে। সেসময় এর প্রস্তুত প্রণালী ছিল অতি গোপনীয়। শেরপুরের বিশিষ্ট দই ব্যবসায়ী বৈকালী দই মিষ্টি ঘরের সত্ত্বাধিকারি রাম প্রসাদ রাজভর এ প্রসঙ্গে বলেন, ঘোষেরা যখন দই তৈরী করত তখন এর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলত। যেকারণে বাইরের কেউ দই তৈরী করতে পারত না। তবে সেটিকে আর তারা ধরে রাখতে পারেনি। এখন শেরপুরেই প্রায় ৫০জন ব্যবসায়ী দই তৈরী করে। এদের মধ্যে মাত্র ৯/১০জন ঘোষ পরিবারের লোক। আর বগুড়া শহরেও আছে বেশ কয়েকটি দই বিক্রির প্রতিষ্ঠান যারা নিজেরাই দই তৈরী করে থাকে। এদের মধ্যে রফাত দই ঘর, মহররম আলী দই ঘর, বগুড়া দই ঘর উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শহরের কয়েকটি বড় হোটেল নিজেরাই দই তৈরী করে। এর মধ্যে আকবরিয়ার দই, শ্যামলীর দই, রুচিতা দই মিষ্টিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত দই তৈরী হচ্ছে।
এক সময় শেরপুরের ঘোষরা চালুনের উপর(বাঁশের তৈরী অসংখ্য ছিদ্র বিশিষ্ট পাত্র) দই তৈরী করেছে। তাদের এই অবস্থান ও পদ্ধতি আর ধরে রাখা যায়নি। স্বাধীনতার পরে ক্রমান্বয়ে প্রতিটি জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করায় এই পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। দুধের বাজার আগে যে অবস্থায় ছিল এখন আর তেমনটি নেই। জ্বালানীরও একই অবস্থা। উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে পেশাটি। যেকারণে ঘোষদের হাত থেকে দই তৈরীর কাজ চলে যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাতে। মূলত বগুড়া থেকেই দই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শেরপুর থেকে বগুড়া শহরে প্রথম দই নিয়ে যান গৌর গোপাল পাল। তিনি ৬০-এর দশকে শেরপুর থেকে বগুড়া শহরে গেলে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাকে বর্তমান নবাববাড়ি সড়কে জায়গা করে দেন। সেখান থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বগুড়ার দই।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এলআই/এফই
নিউজবাংলাদেশ.কম