হাতপাখা বদলে দিচ্ছে শত পরিবারের ভাগ্য
গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় হাতের কারুকাজ খচিত সুই-সুতার হাতপাখা এখন সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জেলার প্রত্যন্ত পল্লীর দুগ্রামের নারী-পুরুষ গরম শুরু হবার সাথে সাথে সুতা দিয়ে রং-বেরঙের বিভিন্ন ডিজাইনের হাতপাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের মানুষ প্রতিদিন হাতপাখা তৈরি করে। এসব পাখা খুচরা ও পাইকারিভাবে বিক্রি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত রসুলপুর ইউনিয়নের আরাজি ছান্দিয়াপুর ও জামালপুর ইউনিয়নের বুজরুক রসুলপুর গ্রাম। ওই দুগ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের শতকরা ৮০ ভাগ নারী-পুরুষ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সুতার তৈরি রং-বেরঙের বিভিন্ন ডিজাইনের হাতপাখা তৈরি করে আসছে। এলাকার মানুষ খামারপাড়া গ্রামকে এখন পাখার গ্রাম নামেই চেনেন। এ গ্রামের বাসিন্দা বয়সের ভারে ন্যুব্জ জলোমাই (৮০) জানান, “এক সময় প্রচণ্ড গরমে মানুষ যখন ওষ্ঠাগত, ঠিক তখন নিজের প্রয়োজনে সুতা দিয়ে হাতপাখা তেরি করি। হাতপাখা তৈরির সময় অন্য মহিলারা এসে দেখে তারাও বাড়িতে গিয়ে হাতপাখা তৈরি করতো। পরে আস্তে আস্তে আশপাশের পরিবারের মহিলারাও সুতা কিনে বাড়িতে বসে হাতপাখা তৈরি করতে শুরু করে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে দুদিনে একটি পাখা তৈরি করা সম্ভব হতো। এক সপ্তাহ শ্রম দিয়ে ৩/৪ টি পাখা তৈরি হতো এবং তা নিয়েই স্বামী-সন্তান আশপাশের বাড়ি ও স্থানীয় মেলায় গিয়ে বিক্রি করতেন। এভাবে দিনদিন ওই গ্রামের নারীরা হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”
পাখা বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় গ্রামের নারী-পুরুষ অনেকেই বেছে নেন পাখা তৈরির কাজ। পাখা তৈরিকারী আব্দুল খালেক জানান, আগে সুতার তৈরি প্রতিটি পাখা ১০-১২ টাকায় বিক্রি করে পাঁচ টাকা লাভ পেতাম। কিন্তু বর্তমানে সুতা ও বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২৫ টাকা দরে বিক্রি করে ৩/৪ টাকা লাভ হয়। প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে গড়ে ৫০-৬০ টি পাখা বিক্রয় করা সম্ভব হয়।
খামারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতে আঙিনার মধ্যে পাটি ও পিঁড়িতে বসে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে পাখা তৈরি করছেন। আবার অনেক বাড়িতে একসাথে নারী-পুরুষর দলগতভাবে আলাপ, হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে কেউ সুতা গোছানো, কেউ বাঁশ কাটা, কেউ চাক তৈরি আবার কেউ সুই দিয়ে সেলাই ও রং বেরঙের ডিজাইন তৈরি করছেন। গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের ৮০ ভাগ মানুষ পাখা তৈরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
গরম বাড়ছে, তারাও পাখা তৈরিতে দিনদিন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দুগ্রামের নারী-পুরুষ মিলে প্রতিদিন এখন এক হাজার থেকে ১৩ শ পর্যন্ত পাখা তৈরি করেন। এসব পাখা জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরা বাড়িতে গিয়ে কেনেন। বিভিন্ন প্রকারের প্রতিটি পাখা তৈরি করতে বাজার থেকে ১২ টাকার সুতা, দুটাকার বাঁশের হাতল, দুটাকার সুতা মোড়ানোর কাপড় ও পারিশ্রমিকসহ প্রায় ২০ টাকা খরচ হয়। পরে তৈরীকৃত পাখা বিভিন্ন গ্রাম, বাজার, দোকান ও মেলায় নিয়ে গিয়ে ২৩ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। একটি পাখা বিক্রি হলে লাভ হয় তিন অথবা পাঁচ টাকা। প্রতিদিনের বিক্রি করা পাখার আয় থেকে তারা পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আবার যারা দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে পাখা তৈরি করছেন তারা সংসার চালিয়ে ওই আয় থেকে মেয়ের বিয়ে, বসতবাড়ি নির্মাণ, গরু-ছাগল কিনে সফলতার মুখ দেখছেন।
অনেকেই এ পাখা তৈরি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ওই গ্রামের পাখা তৈরিকারক আয়েশা বেগম, ছোমেলা বেগম, রেহেনা ও খুকি বেগম আরও জানান, “বছরের তিনমাস পাখা তৈরির কাজ বন্ধ থাকে। তিনমাস সুতা, বাঁশ, কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদ করে রাখি। পরে বছরের ৯ মাসই পাখা তৈরি করে বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীদের চাহিদা পুরণ করতে হিমশিম খাই।”
পাখা তৈরিকারক আনোয়ারুল ইসলাম, ছালাম মিয়া ও এন্তাজ আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয়ভাবে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে এখানে বড় ধরনের পাখা তৈরির কারখানা করা সম্ভব হবে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম