সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে খুলছে নতুন দ্বার
তরিকুল ইসলাম সুমন : দেশের মানুষের মাছের চাহিদা পূরণের জন্য এবার তৈরি হচ্ছে অপার সম্ভাবনা। দীর্ঘ ১৪ বছর বন্ধ থাকার পর আবারো শুরু হচ্ছে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ জরিপ কাজ। আর এটা শুরু করতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থিক সহায়তায় মালয়েশিয়া থেকে ৪০ মিটার লম্বা একটি সার্ভে জাহাজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা।
মৎস্য অধিদপ্তরের চলমান বাংলাদেশ মেরিন ফিসারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক মো. এবিএম আনোয়ারুল ইসলাম নিউজবাংলাদেশ.কমকে জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ৪০ মিটার লম্বা একটি সার্ভে জাহাজ (আরভি মীন সন্ধানী) তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। যা আগামী মাসে দেশে এসে পৌছাবে। এর পরপরই শুরু হবে সামুদ্রিক মৎস্য জরিপের কাজ।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের মিঠা পানিতে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। প্রতি বছর সাগরে ৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা পড়ে। এরমধ্যে মাত্র ০ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ মৎস্যজীবীরা আহরণ করে।
আরো জানা গেছে, বড় ট্রলারের সংখ্যা কম হওয়ায় বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ছোট ট্রলার-নৌকা মাছ ধরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে এখন এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক (ইইজেড) অঞ্চল এবং চট্রগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল (নটিক্যাল মাইল=১.১৫ মাইল) পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সকল ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মৎস্য অধিপপ্তর সূত্র জানায়, ষাটের দশকে জাপানের সহায়তায় বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্যের প্রজাতি, পরিমাণ, মজুদ এবং আহরণের বিষয়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে জরিপকাজ পরিচালনা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে রাশিয়া সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পরে একটি ট্রলার বহরের মাধ্যমে উপকুলীয় দুশো নটিক্যাল মাইল বা ইইএডে এলাকায় জরিপ চালায়। এতে ৪৭৫টি সামুদ্রিক মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ৪টি মৎস্য বিচরণ কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়।
১৯৭৯ সালে আরভি ড. ফ্রিটজফ নানস্যান নামের জরিপ জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় চিংড়ি ও মৎস্য মজুদের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। পরবর্তীতে মৎস্যবিজ্ঞানী ড. ওয়েস্ট উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের ইইজডে ২০০০-৫০০০ মেটন চিংড়ি, এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার মে. টন তলদেশীয় সাদামাছ এবং ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার মে. টন উপরিস্তরের মাছের মজুদ রয়েছে।
ড. ওয়েস্ট এসব জায়গা থেকে বার্ষিক আহরণযোগ্য মাছের পরিমাণও প্রকাশ করেন। তখনকার সময়ে বার্ষিক ৪-৫ হাজার মে. টন চিংড়ি এবং ৪০ থেকে ৫০ হাজার মে. টন সাদামাছ সংগ্রহের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। ১৯৮৩-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) সহায়তায় আরভি অনুসন্ধানী ও এমভি মাছরাঙা দিয়ে জরিপ চালালেও ফলাফল আসে মৎস্যবিজ্ঞানী ড. ওয়েস্টের মতোই। যা ২০০০ সাল পর্যন্ত একই হিসেবে চলছিল।
মৎস্য অধিদপ্তর আরো জানায়, জরিপ জাহাজ এমভি মাছরাঙা অকেজো হয়ে পড়ায় নতুন করে আর কোনো জারিপ চালানো হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক জানান, সার্ভে জাহাজ আরভি মীন সন্ধানী হাতে আসার পরেই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ জরিপ কাজ শুরু হবে। এ জাহাজ দিয়ে দুবছর সমুদ্রে অনুসন্ধান করে মৎস্য আহরণের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে।
প্রকল্প পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম আরো বলেন, সার্ভের শেষে জানা যাবে দেশের উপকূলীয় সমুদ্র সীমায় কী পরিমাণ মাছের মজুদ রয়েছে এবং প্রতিবছর কী পরিমান সংগ্রহ করা যাবে। সর্বশেষ ১৯৮৭ সালের জরিপের ওপর ভিত্তি করেই এখনো মাছ ধরা হচ্ছে।
তিনি জানান, নতুন জরিপ জাহাজ চলে এলে ২৫ বছর আর কোনো চিন্তা না করলেও হবে। এ জাহাজ দিয়েই সব ধরনের জরিপ চালানো সম্ভব হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. আনিছুর রহমান নিউজবাংলাদেশকে.কমকে জানান, সমুদ্রের দুশো মিটার গভীরতায় মাছ ধরার জন্য সরকার ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৯৯ টি এবং আদালতের মাধ্যমে ১০১টি ফিশিং ট্রলারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ২০০ টি ট্রলার সচল থাকলেও পাশাপাশি আরো ছোট ছোট প্রায় ৫০ হাজার নৌযান মৎস্য শিকারের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, ২০০৩ সালে গভীর সমুদ্রে ৫টি লং লাইনার ফিশিং বোটের (বড়শির মাধ্যমে মাছ ধরা) অনুমোদন দেয়া হলেও এখনো একটিও চালু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালে ৩০টি নৌযানের লাইসেন্স দেয়, এরমধ্যে চালু হয়েছে ছয়টি।
এ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আরো ২৫টি ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হলেও এর মধ্যে (মিড ওয়াটার ফিশিং) ১৫টি নরমাল এবং (গভীর সমুদ্রে) ১০টি হচ্ছে লং লাইনার (বড়শি দিয়ে) ফিশিং বোট রয়েছে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসটি/এটিএস
নিউজবাংলাদেশ.কম