এনথ্রোপোসিনের এই কালে শুরু হয়েছে প্রকৃতির নাভিশ্বাস ওঠা
মানুষের হাত পড়েনি এমন জায়গা পৃথিবীতে এখন খুব অল্পই আছে। আর হাত পড়েছে এমন প্রতিটি জায়গার চেহারাই আমুল বদলে দিয়েছে মানুষ। তাই প্রকৃতিকে নিয়ে আমাদের ভাবনার পুনর্বিবেচনা হওয়া এখন খুবই জরুরি।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২, রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানী এন্টার্কটিকা মহাদেশে একটি ইতিহাস গড়েছেন। প্রতিকুল জলবায়ুর ভেতরে প্রায় এক দশক ধরে অনিয়মিতভাবেই কাজ করছিলেন এই গবেষক দলটি, জমাট বরফের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে প্রায় দুই মাইল ব্যাপী দীর্ঘ পথ পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা, শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য তুষার যুগের চেয়েও প্রাচীন এক হ্রদ ভস্টকে পৌঁছুতে। তরল পানির এই ভাঁড়ার প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বছর ধরে একেবারেই আলো-বাতাসের স্পর্শের বাইরে বরফেই ঢাকা পড়েছিল। ইউরোপায় সন্ধান-পাওয়া জলবায়ুর যে তাপমাত্রা ও রাসায়নিক গড়নগাড়ন তার সাথে এর অনেক মিল। এ কারণে, অদ্যাবধি অজানা এমন অনেক অণুজীব এই হ্রদে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ইউরোপা হলো জুপিটার গ্রহের বরফ-ছাওয়া চাঁদগুলোরই একটি। অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব কী করে বজায় থাকে তা বোঝার ক্ষেত্রে ভস্টক হ্রদটির পরিবেশ হয়তো আমাদেরকে সহযোগিতা যোগাবে। তবে ভস্টক অভিযানটি নিজেও কম অসাধারণ ঘটনা নয়! কারণ গ্রহের এমন একটা অংশে বিজ্ঞানীরা পৌঁছুতে পেরেছেন, যেখানে কোন ধরনের মানবীয় স্পর্শই এর আগে পড়েনি। আজকের দিনেও বলা যায়, ভস্টক হ্রদটি এমন দুর্লভ এক জায়গা, যেসব জায়গার সংখ্যা নেহায়েতই হাতে গোনা। আর এখন আমরা নিজেরাই এমন একটি জায়গার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেছি।
যেহেতু হোমো সেপিয়েন্স নামের একটি প্রজাতি এই পৃথিবীর ৪.৫ বিলিয়ন বছর আয়ুর ১%-এর ১%-এর চেয়েও কম সময় ধরে গ্রহটির পিঠে চরে বেড়াচ্ছে, গ্রহের গায়ে তারা নিশ্চয় তাদের পায়ের ছাপ এঁকে দিয়েছে। পৃথিবীর তিন-চুর্তথাংশ তুষারমুক্ত এলাকায় তারা এরইমধ্যে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছে। এখন বিশ্বের গাছপালা জন্ম-বৃদ্ধি-সম্প্রারণ সব ধরনের সক্রিয়তার ৯০%-ই ইকোসিস্টেমের মাঝে সীমায়িত, যে সিস্টেমের ভেতরে মানুষ অনেক বড়ো এক হর্তকর্তা। আমরা ইতিমধ্যেই উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বেশ বড়োসরো অঞ্চল থেকে অরণ্যকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছি, এবং দশ হাজারের মতো প্রজাতিকে ঠেলে দিয়েছি অবলুপ্তির দিকে। অতিরিক্ত মৎস্য-আহরণ আর সামুদ্রিক দূষণের ভেতর দিয়ে আমাদের উপস্থিতি এমনকি মহাবিস্তৃত সমুদ্র, আর বেশ কিছু জনশূন্য প্রান্তরেও বড়ো ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছে। কৃত্রিম সার উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ নাটকীয়মাত্রায় বাড়াতে সক্ষম হয়েছি, এবং এর ফলে জনসংখ্যাও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। এই কৃত্রিম সার উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা বায়ুম-লে বিরাজমান নিস্ক্রীয়গ্যাস থেকে বিশাল পরিমাণ নাইট্রোজেনকে যেমন মাটির অভ্যন্তরের এক সক্রিয় উপাদানে পরিণত করেছি, তেমনি মাটি থেকে এই সারের অতিরিক্ত অংশটুকু নদীসমূহ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে উপকূলসমূহে অনেক মৃত জল-এলাকারও জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে, পৃথিবীর ৭ বিলিয়নের উপরে জনসংখ্যা যে বিপুল কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে তার সবটুকুই বাযুম-লে আছড়ে পড়ছে, আর তা জলবায়ুকে বদলে দিচ্ছে দ্রুতগতিতেই-- এবং গ্রহের যে নিজস্ব চেহারাচরিত্র তাকেও আমূল বদলে দিচ্ছে ।
এখন যেকোন ভৌগলিক বা জলবায়ুগত নিয়ামকের চেয়ে মানুষের কাজকারবারই বরং অনেক বেশি পরিমাণে পৃথিবীর স্বভাবচরিত্র নির্ধারণ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর পিঠে আর আবহমণ্ডলে আমাদের প্রভাব এতোই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে ভূ-মন্ডলীয় কালের নিরিখে যেভাবে পৃথিবীর পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়, বিজ্ঞানীরা এখন বাধ্য হচ্ছেন আমাদের এই প্রভাবকে সেভাবেই পরিমাপ করতে। এখন আমরা হেলোসিন যুগে বাস করছি। এ এক বিশেষ যুগ, যা ১২ হাজার বছর আগে সর্বশেষ বরফ-যুগ সমাপ্ত হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছিল। তবে কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবী করেন যে, আমরা নতুন এক যুগের ভেতরে প্রবেশ করেছি। এ নতুন যুগকে তারা এনথ্রোপোসিন নামেই অভিহিত করতে চান, মানে--মানব যুগ। “পৃথিবীর প্রাণ, রসায়ন, ও ভূগোলগত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানব প্রজাতির আধিপত্য বিস্তারের যে-বাস্তবতা তাকে কোনভাবেই আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না” --বায়ুমণ্ডল সম্পর্কিত রসায়নবিদ নোবেলজয়ী পল ক্রোটজেন এমন কথাই জানিয়েছেন আমাদের। তিনিই প্রথম এনথ্রোপসিন শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বলেন, “এখন আমরা আর ‘প্রকৃতির’ বিরুদ্ধে নই। আমরাই বরং নির্ধারণ করি প্রকৃতি কী, এবং কী হবে।”
সেই ১০ হাজার বছর পূর্বে কৃষিযুগের সুচনা থেকেই মানবজাতি এই গ্রহটিকে পরিবর্তন করতে থাকে, সেই সময় থেকেই হোমো সেপিয়েন্সরা নিখাঁদ শিকারী ও সংগ্রহকারী হিসেবে জীবন যাপনের বদলে ভূ-পৃষ্ঠের উপর উদ্ভিদ ও প্রাণী উৎপাদন করতে থাকে। এ উৎপাদন কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে তারা ভূ-পৃষ্ঠের চেহারাও পাল্টে দিতে থাকে। কৃষিকাজ মানব জাতিকে এমন শক্তিশালী করে তোলে যে তারা ভীষণ হারে বাড়তে থাকে, এবং আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর চেহারাটাকেও তারা পাল্টে দেয়; বর্তমানে ৩৮% বরফ-মুক্ত ভূমি পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে, এবং কৃষির উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু ১৮ শতাব্দির শিল্পবিপ্লবের সূচনার আগপর্যন্ত মানবজাতির বৃদ্ধি ও পরিবেশের উপরে এর প্রভাব এমন বিস্ফোরোণোন্মুখ হয়ে উঠেনি কখনো, এবং সেই সময়ক্ষণেই এনথ্রোপোসিন যুগের শুরু, অনেক বিজ্ঞানীই এমনটা বিশ্বাস করেন। সেই থেকে আমাদের সংখ্যা ১ বিলিয়ন থেকে ৭ বিলিয়নে ফুলে ফেঁপে ওঠে, জীববিজ্ঞানী ই.ও. উইলসন এই প্রজনন-হারের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, “এরা প্রাইমেটদের চেয়েও বেশি ব্যাকটিরীয় হাসলতযুক্ত।” প্রাইমেট হলো বনমানুষ, বানর ইত্যাদি স্তন্যপায়ী প্রাণিদের একটি শ্রেণী। আজকাল পৃথিবীতে অদ্যাবধি পদচারণা করেছে এমন যেকোনো বিশাল সংখ্যার প্রাণী-প্রজাতির বায়োমাসের চেয়ে মানব জাতির বায়োমাস [সমস্ত মানুষের মিলিত জৈবিক পদার্থের পরিমাণ] শতগুণ বড়ো। যেহেতু মানবজাতি কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করতে শিখে গেছে, এই ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের পরিণতিতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরো বেগবান হয়েছে। এই ফসিল জ্বালানি আবহম-লকে আরো দ্রুত উত্তপ্ত করে তুলেছে, এবং একইসাথে আরো বেশি মাত্রায় পৃথিবীর চেহারাকেও পাল্টে ফেলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই তালগোলের মাঝে পারমাণবিক শক্তিকেও আমাদের ব্যবহার তালিকায় যুক্ত করলাম, একই সাথে তেজস্ক্রীয় আবর্জনারও জন্ম দিলাম। এর ভেতর দিয়ে আমাদের উপস্থিতির একাধিক মূর্তচিহ্ন যেমন গ্রহের গায়ে সেঁটে দিলাম, তেমনি বিশ্বজনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক সম্প্রসারনের বেগ একবিন্দু না কমিয়েও আমরা অনেক বেশি পরিমাণে শক্তির অপচয় ঠেকাতে পারলাম। এর পরিণামে এতো বিপুলবেগে পরিবর্তন ঘটতে লাগলো যে, গত অর্ধশতাব্দিকে গ্রেট একসেলারেশন বা মহাগতির কাল বলে অভিহিত করলেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। এই সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উন্নত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার কারণে মানুষের যেমন আয়ু বেড়েছে, তেমনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক বিলিয়ন লোকের সম্পদ ব্যবহারের মাত্রাও বিপুলভাবে বেড়েছে, সে-তুলনায় এ সময়খ-টিতে মন্দার ঘটনা ঘটেছে খুবই কম।
পরিবেশ-ভাবনার ক্ষেত্রে সে-কারণেই এনথ্রোপোসিনরা আজকাল বড়ো ধরনের রদবদল দাবী করছে। ১৯ শতকের একজন স্কটিশ-আমেরিকান প্রকৃতিবিদ ছিলেন জন মুয়ীর, তিনি পরিবেশবাদীদের জন্য সিয়েরা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সময় থেকেই পরিবেশবাদের লক্ষ্য ছিল বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা। যুশিমাইট ও সিকোইয়া ফরেস্টে, তিনিই প্রথম নির্বাধ বুনো প্রকৃতিকে মানুষের কর্মকা-ের আঘাত থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে আমেরিকার শুরুর দিককার বেশকিছু ন্যাশনাল পার্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তখন থেকেই মানুষজনকে দেখা হতে লাগলো বন-প্রান্তর ও প্রাকৃতিকতার প্রতি মূর্তিমান হুমকি হিসেবে, এবং মানুষ ও বনের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করাই সমস্যার সমাধান বলে মনে করা হলো।
কিছুক্ষেত্রে সংরক্ষণ-পন্থীরা সফলতাও পেলেন। এখন সারা পৃথিবীতে ১ লাখেরও বেশি সংরক্ষিত-এলাকা রয়েছে। সে তুলনায় ১৯৫০-এর দিকে ১০ হাজারেরও কম ছিল এমন এলাকার সংখ্যা। এই গ্রহের আনুমানিক ১৩% ভূমি এখন কোনো না কোনো ধরনের আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংরক্ষিত। তারপরেও, আফ্রিকায়, এশিয়ায় এবং লাতিন আমেরিকায় এখনো প্রাচীন অরণ্যসমূহ দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কালে এতো বিপুল হারে নানান প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে যে এই বিলুপ্তির হার অতীতের সেই মহা-অবলুপ্তির কালের সাথে তুলনা করা শুরু হয়েছে। টিকে আছে এমন মেরুদ-ী প্রাণীর এক-পঞ্চমাংশই বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। যদি এই একই হারে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তাহলে এই বিলুপ্তির সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়তে থাকবে। অন্য কথায়, সংরক্ষণ-পন্থী পরিবেশবাদীরা সংরক্ষিত এলাকার ক্ষেত্রে লড়াই করে জয়ী হয়তো হতে পারে, কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের লড়াইয়ে হেরেই যাবে হয়তো। বাস্তবতা হলো, এনথ্রোপোসিন যুগে, প্রকৃতির জন্য কোন সুযোগই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না, অন্তত একে যেমনটা আমরা জানতাম এবং উদযাপন করতাম, তেমন প্রকৃতি হিসেবেতো নয়ই। অর্থাৎ প্রকৃতিকে মানব জাতির চেয়ে আলাদা একটাকিছু, খুবই আদিমকিসিমের একটা কিছু বলে বিবেচনার সুযোগ আর নেই। স্বর্গোদ্যানে ফেরার সুযোগ আর যেমন খোলা নেই, তেমনি অনুমান করাও খুব শক্ত যে সেরকম কিছু আদৌ ছিল কিনা। পরিবেশবাদীদের জন্য, এর অর্থ হলো তাদেও সংরক্ষণ-কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে, সংরক্ষণের এমন উপায় খুঁজে বের করতে হবে যা অধিক জনসহীষ্ণু, এবং মানব উন্নয়নের সমান্তরালে বন্যপ্রাণীদেরও টিকে থাকার সুযোগ দেবে। এক্ষেত্রে বলার কথা হলো, এনথ্রোপোসিনের প্রভাব পুরো গ্রহটাকেই জাড়িয়ে-পাকিয়ে ফেলেছে তাদের এমন বিবেচনাকে প্রশ্রয় না দিলেও, অন্তত তার প্রভাবকে স্বীকার করে নেয়া হোক।
বর্তমানে ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকি হয়ে উঠা ফ্লোরিডা প্রদেশের দাপুটে প্রজাতি বারমিজ পাইথন আর ইলিনয় প্রদেশের এশিয়ান-কার্প প্রজাতিটির বিলুপ্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিবছর শতশত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। যদিও এমন উদাহরণের সংখ্যা বাড়ছে যে, প্রকৃতি নিজের পূর্বাবস্থা পুনরুদ্ধারে আমাদের ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি সামর্থ রাখে। তবু যুক্তরাষ্ট্র অমানুষিক চেষ্টা চালাচ্ছে ‘প্রাকৃতিক’ ইকোসিস্টেমের পূর্বাবস্থাটি ফিরিয়ে আনতে, কিংবা বর্তমান অবস্থাটিকেই অন্তত স্থিতি দিতে। প্রকৃতির সামর্থের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলা যায়, ওজোন-স্তরের দিকে লক্ষ্য করুন: কো¬রো-ফ্লোরো কার্বন অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের আসমানে যে ফাটল ধরিয়েছিল, ২০১১ সালে এসে সে ফাটল পুনরায় ছোট হতে শুরু করলো, এবং বছরখানেক পরেই অধিকাংশ দেশেই এসব রাসায়নিক পদার্থকে এক পর্যায়ে প্রত্যাহারই করে নেয়া হলো।
এনথ্রোপোসিনকে বশে আনতে দুষণকারী কিছু কর্মকা- ও দুষণকারী নির্দিষ্ট কিছু পদার্থের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপই যথেষ্ট হবে না। আরো অনেক বড়ো বড়ো পদক্ষেপ নিতে হবে। এর এই অর্থও দাঁড়াবে যে, পরিবেশবাদীরা প্রায়-সময়েই যে-ধরনের প্রযুক্তির বিরোধীতা করে আসছেন সেসব প্রযুক্তিকেই ফের উৎসাহিত করা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি আর তেজস্ক্রীয় আবর্জনা অপসারণের ঝমেলা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত কার্বনমুক্ত সবচেয়ে বড়ো ব্যবহারযোগ্য শক্তি-উৎস পারমাণবিক শক্তি-খাত। এ খাতকে সম্প্রসারণ করতে হবে। স্বল্প-জমিতে অধিক ফসল ফলানোর সুবিধা দেবে এবং বন্যপ্রাণীদের মূল্যবান জায়গা বাঁচিয়ে দেবে এমন জেনেটিক্যাল মোডিফায়েড শস্যের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। এর মানে হবে, শহরসমূহকেই প্রাধান্য দেয়া, কারণ পৃথিবী-পিঠকে সবচেয়ে স্থিতিশীল এবং সুদক্ষ পুর্নবাসনের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত তীব্র নগর-উন্নয়নই সঠিক পন্থা বলে পরিগণিত হতে থাকবে। আর আমরা যদি দ্রুততার সাথে গ্রিন-হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে না পারি, পৃথিবীর তাপমাত্রা সরাসরি কমিয়ে আনতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃত্রিম মেঘ, কিংবা গ্রহ-আবেষ্টনীর মতো অন্যকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ুর সাথে মানিয়ে নেয়ার সচেতন খামখয়ালিপনা চালিয়ে যাওয়া জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
সত্য যে, শত শত বছর ধরেই মানুষ গ্রহের গায়ে বেশ কার্যকরভাবেই জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং করে আসছে। আমরা এতোদিন ধরে অসচেতনভাবেই তা করছিলাম। নিজেদের নিরবিচ্ছিন্ন সম্প্রসারনেরই অতিরিক্ত একটা উৎপাদ হিসেবেই আমরা এ কাজটি এতোদিন করে আসছিলাম। মানবজাতিই প্রথম প্রজাতি নয় যারা গ্রহ-জুড়ে পরিবর্তন সাধনের এমন কাজকারবার চালিয়েছে। আমাদের পৃথিবীর বায়ুম-ল অক্সিজেন সমৃদ্ধ, এর কারণ অনমিান করতে পারেন কি? আসলে প্রায় ২ বিলিয়ন বছর আগেই সায়ানো-ব্যাকটেরিয়ার দল এই গ্যাস উৎপাদনে পৃথিবীকে সহযোগিতা যুগিয়েছিল। তবে সায়ানো-ব্যাকটেরিয়ারা যদিও জানতো না তারা কী করছে, আমরা কিন্তু জানি, কী করছি আমরা, অন্তত আমাদের তা জানা উচিত। মানব প্রভাবের পুরো পরিধিটাই বুঝে নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। আর এই সচেতনতার বিষয়টাই আমাদেরকে এই গ্রহ-উদ্যানের চাষী বা মালি হিসেবে অনন্য এক দায়বোধের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এ দায় এড়ানোর কোন সুযোগই আর নেই, আমাদের কাঁধে তুলে নেয়া ছাড়া। হোলোসিনদের তৈরি অনুকুল ও উষ্ণ এক জলবায়ুর কারণেই আমাদের প্রজাতিগত অস্তিত্বের বেশ বড়ো সময় জুড়ে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান ছিলাম, এবং নিজেদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলাম আপাত-সীমাহীন এক গ্রহে।
কিন্তু ওই যুগতো অবসিত হয়ে গেছে, এখন এনথ্রোপোসিনদের তৈরি অনিশ্চয়তাই দখল করে নিয়েছে সেই সময়টাকে-- ভূগোলবিদেরা চাই ওই নামে যুগটিকে ডাকুক কি না ডাকুক। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, গ্রহটাকে আমাদের পথে গড়িয়ে নিতে নিতে মানব প্রজাতি কি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে, নাকি শিখার মতোই দপ করে নিভে যাবে। হয়তো তা আমাদের জন্য এক অসুখী সমাপ্তিই ডেকে আনবে, কারণ এমন কোন নিশ্চায়তাই নেই-যে এনথ্রোপোসিনরা, এখন যারা বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের একটা বিশাল ভীড়মাত্র, গত ১২ হাজার বছর ধরে তাদের জীবন ধারণের পক্ষে এ গ্রহটিকে যতোটা অনুকুলে পেয়েছিল, ততোটা অনুকুলে আর থাকবে কিনা। তো গ্রহের উপর “আমরা হলাম দেবতাদের মতোই,” পরিবেশবাদী ও ভাবিষ্যবাদী লেখক স্টিওয়ার্ট ব্যান্ড লিখেছেন, “আর আমাদের অবশ্যই উচিত এর প্রতি একটু সদয় হওয়া।”
অনুবাদ: রথো রাফিা।
নিউজবাংলাদেশ.কম