মুখ পুড়ছে ফর্সা হতে, দৃষ্টি ফেরাও মুখের ক্ষতে
ঢাকা: নিজেকে চকচকে-ঝকঝকে দেখতে কে না চাই? আর তাই নিজেকে আরো সুন্দর করে তুলতে নারীদের চেষ্টার কোনো কসুর নেই। ঘরে বসে রূপচর্চা তো আছেই, এর ওপর রয়েছে নামিদামি বিউটি পার্লার। এসব প্রতিষ্ঠানে নারীর মুখের লুকিং ঝাঁ চকচকে করে বাড়িয়ে দেয় তার সৌন্দর্য।
কোনো কোনো নারীর বেলায় ব্যাপারটা ঘটে বিয়ের বাজারে নিজেকে যোগ্য হিসেবে তুলে ধরতে। এখনো অনেক পরিবার আছে যারা বিয়ের কনে হিসেবে সুন্দরী মেয়েকেই পছন্দ করে। আর কথায়-ই তো আছে, সুন্দর মুখের জয় সবখানে।
কর্মস্থলে সুন্দরী নারীদের একটু-আধটু সুযোগ-সুবধা দেয়া হয়। রাস্তাঘাটেও একই রকম সহযোগিতা মেলে। সবমিলিয়ে নারীদের ক্ষেত্রে সুন্দর হয়ে ওঠার এক রকম সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতি যা দেয় তাকে নতুন করে সাজাতে গেলে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।
প্রসাধন প্রচারে এখন নানামুখী বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার করা হয়। মেয়েটি কালো, এ অপরাধেই সফলতা তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ জাতীয় বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে অনেক নারীই ভোক্তা হয়ে গেছেন রং ফর্সা করার এসব ফেয়ারনেস ক্রিমের।
এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে ধিক্কার উঠেছিল একসময়। ভারতের সংসদেও বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়। কিন্তু এবার স্বাস্থ্যগত কারণে ফর্সা হওয়ার বেশ কয়েকটি ক্রিমকে অভিযুক্ত করলেন চিকিৎসকেরা। ত্বক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বিনা প্রেসক্রিপশনে স্টেরয়েড মেশানো বিপজ্জনক এসব ক্রিম মুখে মেখে ত্বকের জটিল ও দূরারোগ্য ব্যাধি ডেকে আনছে নারীরা।
চিকিৎসকেরা জানান, এ ক্রিম ব্যবহারের ফলে মুখ দগদগে পোড়া দাগে ভরে যাচ্ছে। কিংবা হরমোনের গোলমালে আচমকা দাড়ি-গোঁফ উঠছে মেয়েদের। স্টেরয়েড-নির্ভর রোগী রোদে বেরোলেই মুখের চামড়া ফেটে অসহ্য জ্বালায় জেরবার হচ্ছে।
তারা আরো জানান, মুখের এ অবস্থায় নারীদের হীতে বিপরীত ঘটে যায়। তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। লাগামছাড়া স্টেরয়েড ব্যবহারে ত্বকের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমছে। একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছে।
ভারতে এর আগে ফর্সা হওয়ার চিরকালীন সংস্কারে ঘা মারতে স্টে আনফেয়ার স্টে বিউটিফুল নামে একটি প্রচার চালানো হয়েছিল। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন অভিনেত্রী-সমাজকর্মী নন্দিতা দাস। এরকম প্রচারণা অভিনব, সন্দেহ নেই। কেননা দেখা গেছে, ফর্সা হওয়ার বিভিন্ন ক্রিমের বিপণনে বরাবর বলিউডি তারকাদের মুখের জয়জয়কার।
আর এবার ফর্সা হওয়ার লোভে ত্বকে স্টেরয়েড ক্রিম প্রয়োগের প্রবণতা ঠেকাতে ওইসব তারকাকেই সঙ্গে রাখছেন ত্বক বিশেষজ্ঞেরা। ত্বক বিশেষজ্ঞ কৌশিক লাহিড়ী ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানান, ইদানীং বিভিন্ন বিউটি ক্লিনিকের পরামর্শেও ফর্সা হতে অনেকে মুখে স্টেরয়েড ক্রিম মাখছেন।
তিনি বলেন, বাচ্চা ছেলেকে এমন ক্রিম মাখাতে গিয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটছে। ফর্সা হওয়ার বাতিক দূর করতে গ্ল্যামার জগতের ভিতর থেকে বার্তা আসাটাও জরুরি।
ত্বক বিশেষজ্ঞদের প্রচারের হাতিয়ার বলিউড তারকা মির্জাও স্বীকার করেছেন, কম বয়সে ফর্সা হওয়ার কিছু পণ্যের প্রচার করে ভুল করেছি। ফর্সা হওয়ার চেষ্টায় তার ঘনিষ্ঠ এক স্পটবয় ত্বকের জটিল রোগ ও মানসিক অবসাদে ভুগছে।
চিকিৎসকেরা জানান, ত্বকের প্রতি অবিচার শুধু যে নারীরাই করছে তা নয়। পুরুষও এখন চকচকে ত্বক পেতে মুখে মাখছে এসব ক্রিম। গালে ব্রণ, দাদ, মেচতার কালচে ছোপ ও খুসকির মতো খোসা ওঠার সমস্যায় অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার দরকার মনে করে না। এর বদলে তারা লোকমুখে শুনে স্টেরয়েড মেশানো ক্রিমের সাহায্য নিচ্ছে।
চিকিৎসকেরা বলেন, হাতুড়ে ডাক্তার, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক বা বিউটিশিয়ানদের কথাতেও অনেকে স্টেরয়েড মাখছেন। তাতে কিছু ক্ষেত্রে আপাত সুফল মেলে। কিন্তু ত্বক স্টেরয়েডের নেশার কবলে পড়ে। ক্রিম ব্যবহার বন্ধ করলে সমস্যা আরো বেড়ে যায়।
ত্বক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় ঘোষ গণমাধ্যমকে জানান, শ্বেতি ও এগজিমায় স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম কিছুটা কাজে আসে। তবে তা মুখে মাখা ঠিক নয়। ব্যাপারটি ভালোভাবে না বুঝে কেউ যদি এ ক্রিম ব্যবহার করে তবে তার ফল হবে মারাত্মক।
মুম্বাইয়ের ডাকসাইটের ত্বক বিশেষজ্ঞরাও জানান, তাদের চেম্বারে প্রতিদিন গড়ে দশজনের মধ্যে চারজন তরুণীই মুখে কোনো না কোনো স্টেরয়েড ক্রিম মাখার খেসারত দিচ্ছে। বছর কয়েক আগে ত্বকবিশেষজ্ঞদের সর্বভারতীয় সংস্থার সমীক্ষায় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, পুণে, বডোদরাসহ ১২টি বড়-মেজ শহরে বাছাই-করা সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের বহির্বিভাগে সমীক্ষা চালানো হয়। মুখে ত্বকের নানা সমস্যায় ভুগছে এমন রোগীদের ১৫ শতাংশই ইচ্ছে মতো স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম মাখছিল। তাদের ৩৬ শতাংশই ২১-৩০ বছরের তরুণ-তরুণী।
জানা গেছে, ত্বকে মাখার স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম শিডিউল এইচ-তালিকাভুক্ত। বিনা প্রেসক্রিপশনে তা ক্রেতার হাতে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এ সুযোগে অবাধে বাড়ছে স্টেরয়েড ক্রিমের ব্যবহার। সরাসরি ফর্সা হওয়ার ক্রিম না-বলেও যাদের ব্র্যান্ডনেমেই স্পষ্ট ফর্সা করার টোপ।
এবার সময় এসেছে ত্বকের ব্যাপারে সচেতন হতে। এরই মধ্যে স্টেরয়েড ক্রিম ব্যবহার করে যাদের মুখে ক্ষত হয়ে গেছে তাদের দিকে চেয়ে আমাদের উচিত এবার ক্ষান্ত দেয়া এসব ব্যবহারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের সৌন্দর্য চেহারায় প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় তার ভেতরের রুচিতে।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এটিএস
নিউজবাংলাদেশ.কম