জাহাঙ্গীরনগরে অবাধে মাদক সেবন : ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একরকম বাধ্য হয়েই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সুমন (ছদ্মনাম)। গণরুম থেকে সিনিয়রদের আহ্বানে ক্যাম্পাস মহড়া হয়ে ওঠে বিকেলের রুটিন। এখান থেকেই শুরু ধূমপান। এরপর ধীরে ধীরে গাঁজা, ফেনসিডিল ও মদ পানে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। বাড়ি থেকে পাঠানো অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হয় নেশার পেছনে। এছাড়া রাজনীতি করার শর্তে সিনিয়রদের সহযোগিতা তো রয়েছেই। আবাসিক ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর নেশার হাতেখড়ি হচ্ছে এভাবেই।
যেসব শিক্ষার্থী ইতোপূর্বে সিগারেট পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেননি, তাদের হাতেও এখন গাঁজা দেখা যায়। মাদকাসক্ত অনেকের আক্ষেপ, “আমার জীবনের বড় ভুল এটা। চেষ্টা করেও এখন বিরত থাকতে পারছি না।” ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বসে মাদকের আসর। দিনের বেলায় পরিবহন চত্বর, প্রকৌশল অফিস, টারজান পয়েন্ট, নির্মাণাধীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশ্ববর্তী বাগান। সন্ধ্যার পর পোস্ট অফিসের বারান্দা, হলের ছাদ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চত্বর, টারজান পয়েন্ট ও বটতলার দোকান, খেলার মাঠ, কলেজ মাঠ ও গভীর রাতে লাইব্রেরির বারান্দায় গ্রুপে গ্রুপে বসে মাদকসেবীদের আসর বসে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর এলাকায় অনেক শিক্ষার্থীর ভাড়া বাসায় মাদকের আসর বসে।
বিশ্ববিদ্যালয় জাকসু পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। রয়েছে সুস্থ বিনোদনের অভাব। শিক্ষার্থীদের হাতে অফুরন্ত সময়। তাই সহপাঠীদের সঙ্গে নেশায় কাটছে অতিরিক্ত সময়। বর্তমানে নেশাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে রাজনৈতিক সার্কেল। যে নেতা বেশি অর্থ জোগান দেন তার গ্রুপ তত ভারি। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই কৌতূহল ও হতাশায় পড়ে মাদক নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর ফিরে আসতে পারছেন না। মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে অনেকেই প্রশাসনের নজরদারির অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে মাদকের সহজলভ্যতাকেও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঁজার প্রধান সরবরাহকারী আলী নামের এক ব্যাক্তি। সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে বা বিশমাইল গেটে প্রকাশ্যে তিনি গাঁজা বিক্রি করেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পরিবহন কর্মচারী, হল কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরাও এতে জড়িত। সুইপার পট্টি মদের অন্যতম উৎস। সরকারিভাবে সুইপারদের প্রতি মাসে ৫ লিটার মদ পানের অনুমতি থাকায় এটিকে সুযোগ হিসাবে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে মদ সরবরাহ করে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী আনারকলি বাজার, নবীনগরের বস্তি, সাভারের ধসে পড়া রানা প্লাজার দক্ষিণ পাশের বস্তি (হিরোইঞ্চি পট্টি নামে পরিচিত) থেকেও মাদক সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীরা। মাদক ব্যবসার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীরা জানায়, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হিরোইন সবচেয়ে বেশি চলে। এছাড়া এনার্জি ড্রিংক্স মিক্সড ঘুমের ওষুধ, কাশির সিরাপও ব্যবহৃত হয়। অবাধ সরবরাহের সুবিধার্থে মাদকের রয়েছে ছদ্মনাম। গাঁজাকে পাকু, এম্পোল, কৈলাশ, সবজি, শুকনা, ইয়াবাকে বাবা, ফেনসিডিলকে ডাল ইত্যাদি ছদ্মনামে ডাকা হয়।
মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছিনতাই ও চুরির ঘটনা। হল থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল, মানিব্যাগ, পোশাক চুরির ঘটনা ঘটছে অহরহ। ধারণা করা হচ্ছে, মাদকাসক্তরাই এর সাথে জড়িত। হলের ভেতরে নেশার আসরে মাদকাসক্তরা উচ্চশব্দে গান শোনে। গাঁজার গন্ধে শিক্ষার্থীদের রুমে থাকাটাও দুরূহ বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের মনোবিজ্ঞানী সুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি জানান, “মাদক সেবনে মন ফুরফুরে থাকে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে, দুশ্চিন্তা কমে, শরীরে শক্তি বাড়ে, মাথা খুলে যায়, কাজে মানোযোগ আসে, ভয় কমে এমন কিছু ভ্রান্ত ধারণা থেকেই মাদকাসক্তরা মাদক গ্রহণ করেন।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পিতামাতা সন্তানের খুব একটা খোঁজ রাখেন না বা রাখার সুযোগ পান না। এছাড়া স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্র শিক্ষকের যে সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেটা হয়ে ওঠে না। এটাও মাদক সেবনের একটা অন্যতম কারণ। ”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তপন কুমার সাহা বলেন, “কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ফেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে।”
উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, “যুবসমাজকে ধ্বসের জন্য মাদকেই যথেষ্ট। প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদের সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম