নারীর ক্ষমতায়ন
এগিয়েছে বাংলাদেশ, পিছিয়েছে পাকিস্তান
বাংলাদেশে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান অবদান রাখছেন। নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তারা দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীরা নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন উল্লেখযোগ্য হারে। স্বাবলম্বী হওয়ার আত্মপ্রত্যয়ে নারীরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্যেও নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন।
সেই তুলনায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিশেষ করে পাকিস্তান ও ভারত খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান বরং বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। দেশি-বিদেশি তথ্য-উপাত্ত ও জরিপ অন্তত তাই বলছে।
একটি জরিপে দেখা গেছে, গৃহস্থালী কর্মকাণ্ড ছাড়াও বাংলাদেশে মোট এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছেন। একজন নারী প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেন। স্বামীর সেবা, সন্তান ধারণ, সন্তানের যত্ন, সংসার সামলানো, রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করা, সন্তানের শিক্ষায় শ্রম, বাজার ঘাট করা, ধানভাঙা-এধরনের মোট ৪৫ রকম কাজে একজন নারী নিয়োজিত থাকেন।
মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান ২০ শতাংশ দেখানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর সামাজিক ও পারিবারিক কল্যাণমূলক শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশে, যা মোট জাতীয় উন্নয়নের প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীরা তাদের চাকরির জন্য সপ্তাহে গড়ে ৪৪ ঘণ্টা ও গৃহস্থালি কাজে ৪৯.৮ ঘণ্টা ব্যয় করেন। যা একজন পুরুষের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
রপ্তানিমুখী শিল্পে নারী শ্রমিকদের চাহিদা ও অংশগ্রহণ বেশি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা ও তামাক শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য। যা উৎপাদনের সাথে জড়িত নারীরা। মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ ভাগ অর্জনকারী শিল্পের মূল চালিকাশক্তি নারী। এসব খাতের মোট ৮০ ভাগ শ্রমিকই নারী।
নারীরা এখন কেবল বিভিন্ন শিল্পে বেতনভোগী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। বলা যায়, এ খাতের বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই নারী। দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান বর্তমানে ১০ শতাংশ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, পাকিস্তানের ৭২.২ ভাগ নারী কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। উৎপাদনশীল খাতে ১৩ ভাগ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজে ১১ ভাগ নারী কাজ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫), যেখানে জাতীয় মাঝারি পর্যায়ের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ২০২১ সাল (রূপকল্প-২০২১ নামেও পরিচিত) নাগাদ একটি মধ্য আয়ের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ, নারীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করাকে নারীর ক্ষমতায়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)-২০১৫ অর্জনের নিমিত্তে, লৈঙ্গিক সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, সেই সাথে নারীর প্রতি সব রকমের বৈষম্য দূরীকরণের নিয়মপত্র এবং বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশন বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশ্ব লৈঙ্গিক বৈসাদৃশ্য রিপোর্ট-২০১২ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে আছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে, যা সম্ভব হয়েছে সরকারের নারী-বান্ধব নীতিসমূহের কারণে। বাংলাদেশ লৈঙ্গিক বৈষম্য সূচকে (জিআইআই) পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এই লৈঙ্গিক বৈষম্য সূচকের ১১১তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১২৩তম এবং ভারতের অবস্থান ১৩৩তম।
বিশ্ব নারী পরিস্থিতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা। ২০১৪ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘লিঙ্গবৈষম্য সূচকে’ (জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) বিশ্বের ১৪২টি দেশের মধ্যে এ স্থান পায় বাংলাদেশ। এ সূচকেও পাকিস্তান ১৪১তম অবস্থানে রয়েছে। ভারত রয়েছে ১১৪তম অবস্থানে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯১-৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। গত দশক অপেক্ষা বর্তমান দশকে দারিদ্র্যের হার অধিক কমেছে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তির হার ৯৭ দশমিক ৩, বালকদের ক্ষেত্রে এ হার ৯৬ দশমিক ২ এবং বালিকাদের ক্ষেত্রে ৯৮ দশমিক ২।
জাতিসংঘের কিছু সংস্থার ২০১৩ সালে চালানো জরিপে, বাংলাদেশের মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার প্রতি লাখে জীবিত জন্মগ্রহণের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে ১৭০টি। বর্তমান সরকার এই মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহারকে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি লাখে জীবিত জন্মগ্রহণের বিপরীতে ৬৩টিতে নামিয়ে আনার জন্য কাজ করছে।
নারীর ক্ষমতায়নকে বাড়ানোর জন্য জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০টি করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনগুলোতে নির্বাচিত নারী সাংসদের সংখ্যাও (মোট আসনের ২০%) নিশ্চিতভাবে বাড়ছে। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগবৃদ্ধির জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ এবং মিউনিসিপ্যালিটিগুলোতেও সংরক্ষিত আসন মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাড়ানো হয়েছে এবং পাশাপাশি এসব সিটে নারীরা সরাসরি নির্বাচন কারার সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় নারীর অগ্রগতি হয়েছে, ১২ বছরে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ৬৯ শতাংশ। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৭৪ থেকে কমিয়ে ১৪৩ এ আনা সম্ভব হয়েছে। এখন প্রতি ১ লাখ শিশু জীবিত জন্মে, আর ১৭০ জন মা মারা যাচ্ছেন। ১৯৯০ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ৫৭০ জন। এছাড়া শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৭ থেকে ৬৪ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে।
নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী বলেন, “ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের ঘরের কাজ করতে হয়। নারীদের ক্ষমতায়ন, রাষ্ট্র তথা পরিবারেও স্থান করে নিচ্ছে নারীরা। পুরুষদের চেয়ে নারীরা খুব একটা পিছিয়ে নেই, সরকারি নানা উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়ার কারণে। তেমনি নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান সেইভাবে অগ্রসর হতে পারেনি। শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে নারীরা। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে।
নারীদের উন্নয়নে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও কাজ করে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীরাও অসামান্য অবদান রেখেছিল। স্বাধীনতার পর এই চেতনাই পরবর্তী প্রজন্মের নারীকে শিক্ষিত ও আত্মনির্ভশীলতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সে কারণেই নারীরা আজ জাতীয় উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এই চেতনা ও শিক্ষাই নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করে তুলেছে, নারীর দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন হয়েছে। নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও দক্ষ হয়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে।”
তবে নারী শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। যা একটি বড় অর্জন হলেও নারী শিক্ষার হার সেখানে নগণ্য।
নিউজবাংলাদেশ.কম/কেজেএইচ
নিউজবাংলাদেশ.কম