সামাজিক নিরাপত্তায় এগিয়েছে বাংলাদেশ, পিছিয়েছে পাকিস্তান
ঢাকা: সামাজিক নিরাপত্তায় পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অন্তত ৩ গুণ এগিয়ে রয়েছে। কারণ, পাকিস্তানে বয়স্ক ভাতা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ভাতা, বা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হয় না। অথচ একসময় পাকিস্তানের কাছে শোষিত বাংলাদেশে দেয়া হয় বয়স্ক ভাতা থেকে শুরু করে দুস্থ ভাতা পর্যন্ত।
২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিসব উপলক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ড. নূরুল ইসলাম নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “অবশ্যই পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা অনেক বেশী শক্তিশালী। কারণ, পাকিস্তান কোনো ওল্ড অ্যালাউন্স (বয়স্ক ভাতা) দেয় না। আবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও দেয় না। পাকিস্তান কেবল দুস্থ ভাতা দেয়, তবে তা পরিমানের তুলনায় খুবই কম। বলা যায় পকিস্তানের চেয়ে অন্তত ৩ গুণ বেশী দুস্থ ভাতা দেয়া হয় আমাদের দেশে।”
তিনি আরো বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি দূর্বল হওয়ায় পাকিস্তানে অপরাধ কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ। প্রতিদিনই সেখানে হত্যা, গুমের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা দূর্বল হওয়ায় শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে গিয়েছে পাকিস্তান।”
সংক্ষিপ্ত এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি জানান, “স্বাধীনতার আগে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হয়েছে ৭৫১ মার্কিন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮১৬, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮৪৮, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০৪৪ এবং বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১১৯০ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বিগত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে।”
অতীত ইতিহাস যা বলে: স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বাবুরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) তাদের একটি উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করত। ব্রিটিশরা আমাদের সাথে যে আচরণ করতো, তারাও ঠিক তেমনটি করতে শুরু করল। যার ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের বাবুদের রক্তে মাংসে মিশে যেতে শুরু করলো শোষণ আর বঞ্চনার বদ অভ্যাস। অন্যদিকে হারিয়ে যেতে শুরু করলো মানিবকতার দর্শন, যার প্রভাবে পরক্ষভাবে ধ্বংস হতে শুরু করলো পকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) সামাজিক নিরাপত্তা।
অথচ, দীর্ঘ শোষনের পরও স্বাধীনতার মাত্র ৪৪ বছরে সামাজিক নিরাপত্তায় পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তৈরী হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, যার আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ ইত্যাদি নানামুখী সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার; যা মোট জিডিপির ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালের বাজেট প্রস্তাবনায় এ খাতে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে।
জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা সমাজসেবা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর, সহকারী অন্যান্য দপ্তরের মাধ্যমে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এখানে সেবা গ্রহণকারী বাছাই করতে বড় ভূমিকা পালন করছে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ।
নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘মানবিক প্রগতি ছাড়া অর্থনৈতিক প্রগতি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন কঠিন। উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে মানবিক প্রগতির বিষয়টি বিবেচনায় না নিলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। দেশের সর্বস্তরের মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল তখনই পেতে পারে যখন সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে এবং সমাজে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমে যাবে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। মানবিক প্রগতি বলতে তিনি এ রকমই একটি ধারণা দিয়েছেন বা বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি এ ধরনেরই একটি বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকায় আসেন বরেণ্য এই ব্যক্তি। সে সময় সিপিডি তার জন্য উন্মুক্ত এক বক্তৃতার আয়োজন করে। সেখানেই তিনি এ মতামত তুলে ধরেন।
এদিকে, চলতি বছরের ১১ মার্চ নিজ কার্যালয়ে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র চূড়ান্তকরণ’ সভায় প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘সরকার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে বেশি জোর দিয়েছে। কারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের লক্ষ্য।’
ওয়াশিংটন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস’ প্রজেক্টের চতুর্থ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, সামাজিক নিরাপত্তায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২.১০৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ১.৪২২ স্কোর নিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে ভুটান (অবস্থান ১৬)। এরপর ৭৬ তম স্থানে আছে নেপাল। শ্রীলংকার অবস্থান ১০৫ এবং ১৫৪তম স্থান নিয়ে সূচকে সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। তবে; মালদ্বীপকে এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন আমলের বিদায় লগ্নে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি দেশ। ভারতের দু’পাশে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পরে ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ি স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বে মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএইচকে
নিউজবাংলাদেশ.কম