ব্রত রায়
করোনার কারণে দেশে বেকার হতে পারেন দেড় কোটি মানুষ
করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশই ইতিমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এমনটিই জানিয়েছেন। তিনি বলেন কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত দেড় কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই খারাপ খবর। এই দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য)।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গার্মেন্টস, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ও সরকার এই চারটি খাত ছাড়া বাকি সবই ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক)। করোনায় ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) কর্মজীবী ছাড়া আর সবাই এখন বেকার। বেকারের এই সংখ্যা দেড় থেকে দুই কোটি। তিনি মনে করেন, ফরমাল কর্মজীবীদের মধ্যে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকরাও চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন। কারণ, বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক রফতানি হয়, তার ৬৩ শতাংশ যায় ইউরোপে, বাকি ১৫ শতাংশ যায় আমেরিকায়। দুইটি বাজারেই এখন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, সেখানকার মানুষজন ঘরে বন্দি। এদিকে লকডাউনের কারণে দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোও এখন বন্ধ। বন্ধ এইসব কারখানায় যারা চাকরিতে ছিলেন, সরকারের মাধ্যমে তারা হয়তো আগামী তিনমাস সুরক্ষা পাবেন। এখানেও একটা কথা আছে, বন্ধ কারখানার মালিকরা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ না নেন, তাহলে কিছু করার আছে কি? আর ঋণ নিলেও এটা সাময়িক একটা ব্যবস্থা। এরপরে কী হবে? ব্যবসা করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী রাখবে কেমন করে?
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তাটা সেভাবে নেই। যে কারণে মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকের চাকরি থাকে না। করোনার কারণে এখন অনেকেই চাকরিচ্যুত হওয়া শুরু করেছে। করোনার কারণে কতদিন কারখানা বন্ধ থাকবে, তা কেউ বলতে পারে না। আর যারা পরিবহন শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, দোকানের শ্রমিক বা অন্যান্য ইনফরমাল খাতের শ্রমিক, তারা তো বেকার হয়ে বসে আছে। খোদ রাজধানীতেই কয়েক লাখ বাস শ্রমিক এখন বেকার। ১০ লাখের বেশি রিকশাচালক কর্মহীন। তিনি বলেন, গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়েছে, এর ফলে যারা হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাতের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেসব খাতে শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেকার বসে রয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশন (বিজিআইডব্লিউএফ), বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশন (বিআইজিইউএফ) এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস) বলছে, এই কয়েকদিনে প্রায় ১০ হাজার পোশাকশ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। সংগঠন তিনটির পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে মালিকরা ঢাকা, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানা প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই বা কর্মচ্যুত করেছে। প্রতিদিনই কোনও না কোনও কারখানার শ্রমিকেরা ছাঁটাই বা কর্মচ্যুতির শিকার হচ্ছেন।
তবে তৈরি পোশাক পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দশ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের তথ্য আমাদের কাছে নেই।
এদিকে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ র্যাপিড রেসপন্স গবেষণার তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষ। সারাদেশেই বাড়তে থাকবে দারিদ্র্যের প্রবণতা। বিশেষ করে, শহরের রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রেস্টুরেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষক, জেলে, দোকানি, বিদেশফেরত মানুষেরা এই সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়তে চলেছেন।
এই সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পিপিআরসি ও বিআইজিডি যৌথভাবে র্যাপিড রেসপন্স রিসার্চ প্রকল্প শুরু করে। ১২ এপ্রিল এই জরিপের কাজ শেষ হয়। গ্রাম ও শহরের ৬ হাজার করে দেশের নিম্ন আয়ের মোট ১২ হাজার পরিবারের ওপর টেলিফোনের মাধ্যমে এই জরিপটি করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১৬ এপ্রিল) পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন জরিপের ফল উন্মুক্ত করবেন।
এদিকে বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক ছাড়াও কর্মকর্তাদেরও স্বেচ্ছায় অন্তত ছয় মাসের ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে। এই সময়ে তাদের চাকরি থাকবে। তবে, তারা বেতন-ভাতা পাবেন না। আর অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ যে কোনও কারণে ব্যাহত হলে কিছু লোকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এতে তারা বেকার হন। পরবর্তীতে চাকরি না পেলে গরিব হয়ে যান। করোনা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর যত প্রভাব পড়বে, শ্রম বাজারের ওপরও এর ততটাই প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক সেক্টরে শ্রমিককে ছাঁটাই করতে হলে তার পাওনা-ভাতা দিয়ে বিদায় করতে হয়। কিন্তু সেটা করার মতো মানসিকতা অনেক উদ্যোক্তারই নেই। আর অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, যেমন পরিবহন, হোটেল রেস্তোরাঁয় যারা কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো ততটা জোরালো নয়। তবে, আশার কথা হলো, তাদের জন্য সরকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সেটা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে হয়তো তাদের টিকে থাকার একটা অবলম্বন হবে। তা না হলে, আবার হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।