News Bangladesh

|| নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১১ জুন ২০২০
আপডেট: ০৪:১১, ১২ জুন ২০২০

করোনা: কী হবে শিক্ষার দশা

শহরে অনলাইন ক্লাসের সুফল মিললে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে

করোনা: কী হবে শিক্ষার দশা

করোনাভাইসের মহামারী পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত ১৬ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশে  মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এর পর কয়েক দফা সরকারি ছুটি বাড়ানোর সাথে সাথে শিক্ষাঙ্গনেও ছুটি বাড়ে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর তিন মাস পার হলেও সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ মৃত্যু ও সংক্রমণের রেকর্ড গড়ছে দেশ। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ছুটি শেষ এবং গণপরিবহণসহ সকল অফিস আদালত খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিগগিরই খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ রাখার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন অচলাবস্থার মধ্যে কী হবে শিক্ষার অবস্থা? এরই মধ্যে স্কলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় পেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার সময় চলে যাচ্ছে। তাই বার্ষিক পরীক্ষার টার্গেট নিয়ে অনলাইনে পাঠদান শুরু করেছে অপেক্ষাকৃত উন্নত স্কুল-কলেজগুলো। এর আগেই সরকার সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারলেও পিছিয়ে পড়ছে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা।
করোনাভাইরাসের কারণে সরকার গত মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর এপ্রিল পর্যন্ত ঈদসহ নানা ছুটির কারণে মে মাস থেকেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করে অনেক স্কুল।
রাজধানীর সরকারি বেসরকারি বিশেষ করে সুপরিচিত স্কুলগুলোতে এক মাস ধরেই এমন চর্চা চলছে।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, যশোর, রাজশাহী ও সাতক্ষীরাসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে এ ধরনের অনলাইন শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু করেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
তবে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের চেয়ে বেসরকারি স্কুলগুলো বিশেষ করে ইংরেজি মিডিয়াম বা উভয় মাধ্যমের পরিচিত স্কুলগুলো ফেসবুক বা জুম ব্যবহার করে অনলাইন পাঠদান শুরু করে গত মাসের শুরু থেকেই।
তবে শহরাঞ্চলে ঠিক কত স্কুল অনলাইনে পাঠদান শুরু করেছে আর কতগুলোতে চালু করা যায়নি তার কোনো হিসেব নেই।
আবার সরকারি স্কুলগুলোতে অনলাইনের চেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে সংসদ টিভির মাধ্যমে স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদান প্রক্রিয়াকে।
ফাইজা শামস সামান্থা ঢাকার ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মে মাসের শুরু থেকেই তাদের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়।
কখনো ফেসবুক লাইভ কিংবা জুম ব্যবহার করে শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাসে অংশ নিতে মায়ের মোবাইল ব্যবহার করে ফাইজা।
তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফেরদৌসি রেজা চৌধুরী জানান, দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত অনলাইনে প্রতিদিন এভাবেই ক্লাস করতে হচ্ছে তার মেয়েকে।
শহরগুলোর বাইরের শিক্ষাদান পরিস্থিতি: ভোলার দক্ষিণের উপজেলা চরফ্যাশনের টি ব্যারেট স্কুলের শিক্ষিকা শামসুন্নাহার স্নিগ্ধা বলেন, তারা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেলকেই বেশি ব্যবহার করছেন।
সরকারি পোর্টাল শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে তাদের আগে থেকে রেকর্ড করা কনটেন্ট ইউটিউবে দেয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদেরও জানিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, “আমরা অনেকে আমাদের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও কনটেন্টগুলো দিই যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে পেতে পারে। অনেকেই সেগুলো দেখে ও সে অনুযায়ী পড়াশোনা করছে এই বন্ধ সময়টাতে।”
শামসুন্নাহান স্নিগ্ধা বলেন, “অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বশেষ তিনি ইউটিউবের মাধ্যমে চারটি ক্লাস করিয়েছেন।”
প্রসঙ্গত, শিক্ষক বাতায়নে অন্তত চার লাখ ২৫ হাজার শিক্ষক সংযুক্ত আছেন এবং ইতোমধ্যেই তাদের জমা দেয়া কনটেন্ট আছে আড়াই লাখেরও বেশি।
এতে স্কুলের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও সংযুক্ত থাকায় সারাদেশে এটি স্কুল মাদ্রাসাগুলোর সাথে ভালোভাবেই জড়িত।
শহরগুলোতে এই সুবিধা থাকলেও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদান সম্ভব হচ্ছে না।
লক্ষ্মীপুরের গ্রাম চর রুহিতার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্লাহ বলেছেন, “উপজেলা সমন্বয় সভায় তাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে যেন তারা শিক্ষার্থীদের সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাসগুলো দেখতে উৎসাহিত করেন। আমাদের এখানে যেসব শিক্ষার্থীর বাসায় টিভি নেই তাদের তালিকা করছি। তাদের পরামর্শ দিচ্ছি যাদের বাসায় টিভি আছে সেখানে শ্রেণিওয়ারী পাঠদান হচ্ছে সেগুলো যেন তারা দেখে নেয়।
ঢাকায় অনলাইন ও অন্য জায়গায় টেলিভিশন: স্কুল কবে খুলবে তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় ঢাকার অনেকগুলো স্কুলে অনলাইনে শিক্ষাদান করা হচ্ছে সরাসরি। কিন্তু ঢাকার বাইরে যেখানে ইন্টারনেট আছে সেখানে রেকর্ডেড ক্লাসগুলো পাচ্ছে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা।
এর বাইরে মূলত সংসদ টিভিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদান করা হয়।
অনেক স্কুল আবার নিজেদের ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনকার ক্লাসগুলো পরে আপলোড করে দিচ্ছে।
তবে এটা আসলেই তারা পাচ্ছে যারা আগে থেকেই সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের নাম ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি সুবিধাবঞ্চিত কত শিক্ষার্থী: সরকারি হিসেবে দেশে প্রাথমিক স্কুল আছ ৬৪ হাজার আর অন্যদিকে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরো ১৭ হাজারের মতো। আর কলেজ বা মহাবিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। আর সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই এই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
অর্থাৎ এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফসিহউল্লাহ বলেন, “কারা ইন্টারনেট ও টিভির আওতায় আছে এবং বাসায় কার কোন ধরনের ফোন আছে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এটি ঠিক যে অনেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। তবে এখানে সামর্থ্যের বিষয় জড়িত। তাই আমরা অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে কাজ করছি।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অর্ধেকের মতো শিশু টিভি সুবিধার আওতায় আছে।
মহাপরিচালক বলছেন, সারাদেশের সব অভিভাবকদের সাথে এলাকার শিক্ষকদের যোগাযোগ আছে। তাদের মোবাইল নম্বর আছে। শিক্ষকরা কথা বলছেন। তথ্য নিচ্ছেন। অভিভাবকদের মাধ্যমে পড়াশোনার নির্দেশনাও দিচ্ছেন। আবার অনেক শিক্ষক ইউটিউবে আছেন। যদিও ইন্টারনেট এখনো সবজায়গায় নেই। তবে অনেক জায়গাতেই আছে এখন।”
এডুকেশন হেল্প লাইন ৩৩৩৬: প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সাথে সরকারের এটুআই কর্মসূচির সমন্বয়ে এই এডুকেশন হেল্প লাইন চালু হবে শিগগিরই যার উদ্দেশ্যই হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যপ্তি বাড়ানো। এটি বাস্তবায়ন হলে ৩৩৩৬ নম্বরে কল দিয়ে শিক্ষার্থীরা তার দরকারি বিষয়ে নিজের শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, “প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই এ সুযোগ পাবে এবং সহসাই এটি চালু হবে। এখন শিক্ষকদের ডাটাবেজ যুক্ত করা হচ্ছে। এখানে কল দিয়ে শিক্ষকের সাথে সংযুক্ত হবার পর থেকে পরবর্তী পাঁচ মিনিট বিনামূল্যে কথা বলার সুযোগ পাবে একজন শিক্ষার্থী।
রেডিওতে পাঠদান: বাংলাদেশ বেতারকে পার্টনার করে একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার যাতে যুক্ত থাকবে এফএম ও কমিউনিটি রেডিওগুলো। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসের শিক্ষকদের মাধ্যমে শুরু হবে এই বেতার কার্যক্রম।
ফসিউল্লাহ বলছেন, রেডিও ও ইন্টারনেটের চেয়েও এখনো রেডিও কাভারেজ বেশি আছে এবং সেটিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা যাবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা: মার্চের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নিতে পরামর্শ দেয়। তবে পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলে পরে আবার নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে আবার বলা হয় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী থাকলে অনলাইনে ক্লাস নেয়া যাবে এবং মূলত এর পরেই বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ কার্যক্রম শুরু করে।
সর্বশেষ যে নির্দেশনা তাতে দেখা যাচ্ছে অসমাপ্ত পাঠ্যসূচির অনলাইন ক্লাস থাকবে কিন্তু ল্যাবরেটরিভিত্তিক ক্লাস পরে স্বাভাবিক অবস্থা এলে শেষ করা হবে।
তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা কার্যত এ সুযোগ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়