র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ১৬ মাস পর বাড়ি ফিরলেন যুবক
১৬ মাস পর বাড়ি ফিরেছেন নিখোঁজ মো. রহমত উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট করায় ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার ধামরাইয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার ১৬ মাস পর বাড়ি ফিরেছেন নিখোঁজ মো. রহমত উল্লাহ (২১) নামে এক যুবক।
রবিবার (২২ ডিসেম্বর) বিকাল দিকে ঢাকার ধামরাই উপজেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের বড়নালাই গ্রামে বাড়িতে ফেরেন তিনি।
জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাতে র্যাব পরিচয়ে একটি দল রহমত উল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। প্রায় ১৬ মাস পর রবিবার দুপুরের দিকে বাড়িতে পৌঁছান রহমত উল্লাহ (২১)।
তার পরিবারের লোকজন জানায়, ফেসবুকে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে পোস্ট করেছিলেন রহমত উল্লাহ। ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাত ১২টার দিকে র্যাব পরিচয়ে রহমত উল্লাহকে তুলে নেওয়া হয়। পরে র্যাবের মানিকগঞ্জ ক্যাম্পে যোগাযোগ করা হলে রহমতকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি তারা জানে না বলে দাবি করে।
ছেলেকে পেয়ে রহমত উল্লাহর মা মমতাজ বেগম বলেন, ছেলেরে আমি পাইছি, আমি শান্তি পাইছি। আল্লায় আমার ছেলেরে আমার বুকে আনছে।
তিনি বলেন, আমার ছেলের ৮ দিন জ্বর আছাল (ছিল)। আমার কাছেই শুয়া আছাল, র্যাব আর সাদাপোশাকে মানুষ ঘরে আইসা ধইরা নিয়া গেছিল। তারা কইছিল জিজ্ঞাসাবাদ কইরা ছাইড়া দিমু। র্যাব অফিসে, ডিবি অফিসে, পুলিশের কাছে গেছি কতবার, কোনো খোঁজ পাই নাই। আমার বাবারে এখন ফিরা পাইছি।
তিনি জানান, ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ ডায়েরি পর্যন্ত নিতে চায়নি থানা পুলিশ। প্রায় দেড়মাস পর নিখোঁজ ডায়েরি নেয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ। অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান। ওবায়দুল্লাহ খোঁজ নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর পরিবারের ৪ সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে যান।
রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লা বলেন, শনিবার দুপুরের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফজলে রাব্বি আমাকে কল করে বলেন, আপনার ভাইকে পাওয়া গেছে, আমাদের কাছে আছেন। আপনারা নিয়ে যান।
তিনি বলেন, এসআই মো. ফজলে বারীর কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রহমত উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসি। শুরুতে রহমত উল্লাহ আমাকে চিনতে পারছিল না। এখনো খুব বেশি কথা বলতেছে না।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল। পাসপোর্ট না থাকায় ভারত প্রশাসন ভাইকে ছয় মাসের জেল দেয়। শুক্রবার আমার ভাইসহ মোট ১৪ জনকে ভারতের বিএসএফ একটি নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি রেল স্টেশনে ১৪ জন বাংলাদেশি আসেন। সেখান থেকে ১৩ জন তাদের বাড়ি চলে যান। আমার ভাই সেখানেই বসে থাকলে স্থানীয়রা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললে ভাই পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে যান। সেখান থেকে আমাদের জানানো হয়।
বাড়িতে ফিরেও অনেকটাই চুপচাপ রহমত উল্লাহ। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। প্রশ্ন করা হলে চুপ থাকছেন। কিছু প্রশ্নের অল্প কথায় জবাব দিচ্ছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার পুলিশ জানায়, থানায় আসার পর রহমত উল্লাহ তাদের জানিয়েছেন, গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে র্যাব তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ঢাকায় ৯ মাস চোখ, হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়। যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, এর আশপাশে বিমান ওঠানামা করত। শুধু খাওয়ার সময় চোখ খোলা রাখা হতো। খাওয়া শেষ হলে আবার তার চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এভাবে ৯ মাসের মতো রাখার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাইয়েস গাড়িতে করে তাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে রহমত উল্লাহকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দু-তিন দিন ভারতে ঘুরার পর ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
রহমত উল্লাহ পুলিশকে জানিয়েছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাকে একটি জেলে রাখা হয়। সেখানে ৬ মাসের সাজা হয়। এ ছাড়া ১ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ মাস জেল খাটতে হবে—এমন সাজা হয়। ৭ মাস জেল খাটার পর সর্বশেষ দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয়। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাকে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়। পরে তিনি গোমস্তাপুর থানায় যান। এরপর থানা-পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরিবারের তথ্য নেয়।
রহমত উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদকারী রহনপুর তদন্তকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ মো. ফজলে বারী বলেন, প্রথমে রহমত উল্লাহ সন্দেহ করছিলেন, পুলিশ তাকে মেরে ফেলতে পারে। তবে পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে তার কাছ থেকে পরিবারের তথ্য নিয়ে ধামরাই থানা-পুলিশের সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যরা থানায় পৌঁছালে নিশ্চিত হতে শনাক্তকরণ মহড়া হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ৫ জন লোককে তার সামনে রেখে ভাইকে শনাক্ত করতে বলা হলে তিনি ভাইকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
মো. ফজলে বারী বলেন, তাকে (রহমত উল্লাহকে) জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাকে ধরল কেন? সে উত্তরে বলেছিল, তারা বলছে (র্যাব) আমি নাকি জঙ্গি করি। তখন সিডিএমএস (সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সার্চ করে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাইনি।
গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল বাসার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, ৯ মাস তাকে দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে রেখেছিল। এরপর যশোর সীমান্ত এলাকায় মোটরসাইকেলওয়ালা দুজন লোকের কাছে দেওয়া হয়। পরে ওরা ভারতে নিয়ে যায়। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে যাওয়ায় ভারতের পুলিশ মামলা দিলে ৭ মাস জেল খেটেছেন। গত পরশু গভীর রাতে নৌকা করে রহমত উল্লাহকে নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে তিনি লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এটা কোন এলাকা? লোকজন তাকে এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর জানান। এরপর তিনি থানার আসেন।
ভুক্তভোগী রহমত উল্লাহ বলেন, র্যাব পরিচয়ে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়। এর পরপরই কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। বাড়ি থেকে বের করার পর কখন কোথায় নিয়ে যায়, কিছুই বলতে পারব না। আমাকে বাংলাদেশে কয়েক মাস রাখার পর ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই এতদিন ছিলাম। আমার তেমন কিছুই মনে পড়ছে না।
নিউজবাংলাদেশ.কম/পলি