ভৈরব নদ খননে অনিয়ম, নৌ-চলাচলের স্বপ্ন ফিকে
ঠিকাদারের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ২৭৪ কোটি টাকার ভৈরব নদ খননের কাজ ভেস্তে যেতে বসেছে। কোথাও থেকে বালি বিক্রি, কোথাও থেকে মাটি বিক্রি করে করা হচ্ছে নদ খনন। আবার যেখান থেকে মাটি অথবা বালু বিক্রি করতে পারছেনা সে অংশে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে চারণভূমি হয়ে।
উল্লেখ্য, বসুন্দিয়া আফ্রার ঘাট থেকে চুয়াডাঙ্গা দর্শনার দামুড়হুদা পর্যন্ত ভৈরব নদ খনন করে নৌ চলাচলের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উদ্বোধনের সময় নদের নাব্যতা ফিরিয়ে নৌ-যোগাযোগের ব্যবস্থা করার জন্য ভৈরব নদ খননের প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৩ সালে নদের নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যশোরে ভৈরব নদ খনন ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য গত ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট একনেকে প্রকল্পের জন্য ২৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকা অনুমোদন দেন। কিন্তু প্রকল্পের সফলতা নিয়ে প্রথম থেকে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
কাজের শুরু থেকেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের নদী খননে অনভিজ্ঞ ও খননের আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বৃহত্তর এ প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেয়ার পর একাধিক ঠিকাদার মোটা অংকের কমিশনে প্রাপ্ত কাজ স্থানীয় বেশকিছু প্রভাবশালী ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন। কাজ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার মধ্যে অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু অংশ যন্ত্রপাতি ভাড়া নিয়ে লোক দেখানো দায়সারাভাবে ইতোমধ্যে কাজের প্রায় ৯০ শতাংশ শেষও করেছে। তবে বিধি বাম। শেষ হওয়া অধিকাংশ এলাকার নদ আবারো ভরাট ও হয়ে গেছে। সে সব খননকৃত নদে আবারও জলজ উদ্ভিদ জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
ভৈরব (হৈবতপুর অংশের) নদের তীরে বসবাসরত ৯০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে শামসের মোল্লা বলেন, “একসময় এই নদী দিয়ে দড়াটানা, বসুন্দিয়া, নোয়াপাড়াও খুলনাতে নৌকায় করে মালামাল নিয়ে যাওয়া হতো। এখন আর এই নদীতে কোনো নৌকা চলে না। নদী এখন খালে পরিণত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের মানুষের কথা মাথায় রেখে এই নদী খননে শুনেছি প্রায় ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু ঠিকাদাররা নদী খননের নামে প্রহসন করছে। নদীর দুই পাশের মাটি কেটে বিক্রি করছে। সামান্য কিছু মাটি লোক দেখানোর জন্য দুই ধারে ঢিবি করে রেখেছে। বরং নদীর মাটি ও বালু বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে আরো কয়েক কোটি টাকা রোজগার করছে। তাই এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আমি জোর দাবি জানাচ্ছি, সরকারের এই বিপুল পরিমাণের বরাদ্দের টাকা যেন বিফলে না যায়। নামসর্বস্ব কাজ করে ঠিকাদাররা যেন এই টাকা লুটপাট করে খেয়ে না ফেলতে পারে তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। যদি সঠিকভাবে নদী খনন না করা হয় তাহলে এ অঞ্চলের সব মানুষের স্বপ্ন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভৈরব নদটি যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে যশোর শহরের বুক চিরে বাঘারপাড়া ও অভয়নগর হয়ে খুলনার রূপসা নদীতে গিয়ে মিলেছে। ভৈরব নদের অববাহিকার মানুষের কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল একসময়। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদের প্রবাহের সঙ্গে ভৈরব নদের নদের প্রবাহ সংযোগ রয়েছে। অনেক দিন আগেই চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটারের মাথাভাঙ্গা নদীটি ভরাট হয়ে যায়। এর ফলে ভৈরব নদের উৎসে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে ভৈরব নদের যশোর অংশে নাব্যতা বিলীন হয়ে যায়। নদ ভরাট হয়ে রূপান্তিরত হয় খালে। এই নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বর্তমানের সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেন ভৈরব নদে নৌ চলাচলের। তারই ভিত্তিতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম ১৫ জন ঠিকাদার এ বিপুল পরিমাণ টাকা নামসর্বস্ব কাজ দেখিয়ে লুটপাট করছে। তবে যশোরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান বলেন, নদ খননে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের খননে তীক্ষ্ণ নজর হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোর ভৈরব নদ খননে ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৮টি লটে এ বৃহত্তর পরিসরের কাজ পায়।
যশোর মুজিব সড়কে অবস্থিত এসটি ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি পায় দু’টি লটের কাজ। একটি ভবন মেরামতও রক্ষণাবেক্ষণ অন্যটি পায় দু’কিলোমিটার নদ পুনঃখনন।
রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে অবস্থিত ডলি কন্সট্রাকশন লিঃ- এসএ-এস আই জেভী) নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিনটি লটে পায় সাত কিলোমিটার পুনঃখনন।
যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার নুর হোসেন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি চারটি লটে প্রায় ১২ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এস এ-এমএসএ-এনএইচ(জেভী) নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি একটি লটে প্রায় চার কিলোমিটার পুনঃনদীখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এনএইচ-এমএসসি-এস এ ইউ (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৮টি লটে পায় ২৮.৫০০ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার টেকনিপ কর্পোরেশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি একটি লটে প্রায় তিন কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার কপোতাক্ষী এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি চারটি লটে প্রায় ১১ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা বিবি রোড এলাকার রেজা এন্ট্রারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি একটি লটে প্রায় তিন কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়। এসএস এবং এম টি (জেভী) নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দুটি লটে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা ১৯২ কাজী পাড়া এলাকার শামিম চাকলাদার নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিনটি লটে প্রায় নয় কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এম টি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দুটি লটে প্রায় ৬ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়।
সাতক্ষীরার ইটাগাছা এলাকার শেখ আশরাফ উদ্দিন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি একটি লটে প্রায় দুই কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
খুলনা ক্রস রোড-২,৩৭ দক্ষিণ টুটপাড়া এলাকার শামিম আহসান নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিনটি লটে প্রায় ৭.৫০০ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়। খুলনা ১৮ গগন বাবু রোড (২য় লেন) এলাকার আমিন এন্ড কোং নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তিনটি লটে প্রায় ১০ কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়।
চুয়াডাঙ্গা জীবন নগরের জাকাউল্লাহ এন্ড ব্রাদার্স নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি একটি লটে প্রায় তিন কিলোমিটার পুনঃনদখননের কাজ পায়। এসব ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
খুলনার ঠিকাদার শামিম আহমেদের কাছে নদ খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভরাট হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি তিনটি লটের কাজ পেয়েছিলাম। তার মধ্যে দুটির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি কাজ চলমান রয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “নদীর বক্ষে কাদা থাকায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে, শুকনো মৌসুমে কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।”
যশোরের পুরাতন কসবা এলাকার রেজা এন্টারপ্রাইজের মালিক রেজার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমিও কাজের ৯০% শেষ করে ফেলেছি। সমাপ্ত হওয়া কাজের অংশ আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কাজের সিডিউল অনুযায়ী বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপর আবার নদ ভরাট হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড আবার টেন্ডার দেবে। আমরা আবার কাজ করব। এভাবেই তো চলবে নদ খনন। একবারে তো আর পুরোপুরি নদ খনন করা সম্ভব নয়।”
ঠিকানা বিহীন এম টি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম ও এস টি এন্ড এম টি (জেভী) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ইমদাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা তিনটি লটের বার বাজার চৌগাছা এলাকায় কাজ পেয়েছিলাম। সেটি অনেক আগে শেষ করেছি। এখন যদি সেগুলো ভরা হয়ে যায় তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই।”
অফিসের ঠিকানার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি সাথে সাথে তার ফোনের লাইনটি বিছিন্ন করে দেন। পরে বার বার তার ফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির বলেন, “জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ভৈরব নদ খনন পকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার ঠিকই। নদটির সংস্কার নিয়ে যশোরের মানুষের অনেক স্বপ্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও স্বপ্ন ছিল এই নদ আবার যৌবন ফিরে পাবে। এ নদে আবার চলবে নৌযান। এই নদের কারণে আবারো এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নদ খননে এ বিপুল পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এ অঞ্চলের মানুষ ও ভেবেছিল নদটি সংস্কার হলে নদের যৌবন ফিরে পাবে। নদটিতে আবারো নৌকা চলবে। কিন্তু সঠিকভাবে কাজ না হওয়ায় নদে নৌকা চলা তো দূরের কথা সঠিকভাবে পানির প্রবাহও চলছে না। কিছু অসাধু ঠিকাদার নামমাত্র নদ খনন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জোর দাবি, সরকারের এ বিপুল পরিমাণ বরাদ্দকৃত অর্থের যেন সঠিক ব্যবহার হয়। এসব অসাধু ঠিকাদারদের চিহ্নিত করে যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তোহিদুল ইসলামের কাছে ভৈরব খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই নদী ভরাট হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি নদ খননের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি। কোনো ঠিকাদার নামসর্বস্ব কাজ করে যেন টাকা হাতিয়ে নিতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। কোনো ঠিকাদার কাজে অনিয়ম করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ