News Bangladesh

ঝিনাইদহ সংবাদদাতা || নিউজবাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ৯ এপ্রিল ২০২১

ঝিনাইদহের লক্ষাধিক নলকূপ মাসের পর মাস পানিশূন্য

ঝিনাইদহের লক্ষাধিক নলকূপ মাসের পর মাস পানিশূন্য

হুমকির মুখে পড়েছে ঝিনাইদহের জনস্বাস্থ্য। জেলার লক্ষাধিক নলকূপ মাসের পর মাস পানিশূন্য অবস্থায় রয়েছে। পানির জন্যে চলছে হাহাকার। মাঠ-ঘাট, বিল-ঝিল, জলাশয়, পুকুর-নদী কোথাও নেই পানি। পানি নেই নলকূপেও। 

জেলার ছয়টি উপজেলায় লক্ষাধিক নলকূপে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এর মধ্যে জেলার শুধুমাত্র শৈলকুপা উপজেলাতেই ৩০ হাজার নলকূপ পানির অভাবে অকেজো হয়ে গেছে। এ ছাড়া সদর, কালীগঞ্জ, মহেশপুরসহ বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো নলকূপেই পানি উঠছে না। গত কয়েক মাস ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। কিছু কিছু জায়গায় পানি মিললেও চলতি মাসের শুরুতে একেবারেই পানিশূন্য সব নলকূপ। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলি ক্রমেই পানি শূন্য আর গরমের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে সব নলকূপই এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এ অঞ্চলে গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বৃষ্টিও নেই। ফলে ক্রমেই অবস্থার অবনতি অব্যাহত রয়েছে। 

তাছাড়া কৃষকেরা জানান, গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রত্যেক শুষ্ক মৌসুমে তাদের সেচ খালগুলিতে পানি দিয়ে থাকে। কিন্তু এবারে কোনো ধরনের পানি ছাড়েনি প্রকল্প থেকে। সেচ খালে পানি প্রবাহ থাকলে নলকূপগুলোতেও পানির স্বাভাবিকতা কিছুটা থাকে। 

তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে সুপেয় পানিরও। গ্রামাঞ্চলে প্রত্যেক বাড়ির নলকূপ অকেজো। ফলে একদিকে রান্না-বাড়াসহ ঘর-গৃহস্থালির কাজে যেমন অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে অন্যদিকে গরু-ছাগল বা গৃহপালিত পশু-পাখির জন্যও পাচ্ছেনা বিশুদ্ধ পানি। এমন অবস্থায় হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। 

তবে জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বাড়িতে নলকূপ বসিয়েছে তারা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিয়ে নলকূপ স্থাপন করলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে। ডিজাইন অনুসারে টিউবওয়েল না বসালে প্রত্যেক শুষ্ক মৌসুমে এটি ঘটতেই থাকবে। 

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহে রয়েছে ছয়টি উপজেলা। এগুলো হলো- শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুণ্ডু ও ঝিনাইদহ সদর। জেলার ভেতর দিয়ে নবগঙ্গা, কুমার, বেগবতি, চিত্রা, কপোতাক্ষ, গড়াইসহ বেশকিছু নদনদী প্রবাহিত। তবে একমাত্র গড়াই বাদে সবই এখন মৃত, হচ্ছে ফসলের চাষ। 

অনুসন্ধান ও তথ্য নিয়ে জানা গেছে, জেলার উপজেলাগুলোর ভেতরে শুধুমাত্র শৈলকুপাতেই রয়েছে ৩৭ হাজার পাঁচশ নলকূপ। যার ভেতরে এ মুহূর্তে ৩০ হাজার নলকূপ পানির অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে। এতে দুই লক্ষাধিক মানুষের জীবনযাত্রা এখন প্রায় অচল। 

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর শৈলকুপা উপজেলার কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ উপজেলায় ৩৭ হাজার পাঁচশ নলকুপ রয়েছে, তার মধ্যে সরকারি নলকূপ মাত্র ১৫শ, বাকি সব ব্যক্তিমালিকানার। এসবের ভেতরে ৩০ হাজারই এখন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। 

তিনি বলেন, “পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় এমন সংকট দেখা দিয়েছে।”

কালীগঞ্জ উপজেলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা জানান, উপজেলার বেশিরভাগ টিউবওয়েলে পানির সংকট শুরু হয়েছে। তাদের অফিসপাড়ার চারটি নলকূপই অকেজো বলে জানান। 

সরেজমিনে শৈলকুপার ধলহরাচন্দ্র ,কুশবাড়িয়া, মনোহরপুর, বিজুলিয়া, হিতামপুর, পৌরসভার হাবিবপুর, কবিরপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সব অগভীর নলকূপ অকেজো। গত মাসে কিছু নলকূপে সামান্য পানি উঠলেও চলতি এপ্রিলে এসে একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে সব নলকূপ। গ্রামের দারিদ্র মানুষগুলো এমন অবস্থায় নদনদী বা দূরের কোন জলাশয় থেকে পানি এনে ফুটিয়ে তা পারিবারিক সব কাজে ব্যবহার করছে।

মনোহরপুর গ্রামের গৃহবধু সাগরী, কৃষক মোকন মিয়া, বিজুলিয়া গ্রামের কৃষক ভুন্ডলে মিয়াসহ অনেকে জানান, গত কয়েকমাস ধরেই তাদের নলকূপে কোনো পানি নেই। শুধু গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে বাড়িতে নয়, পানি নেই স্কুল-কলেজ, বিদ্যালয়ের নলকূপ, পানি নেই হাসপাতালের নলকূপেও। হাট-বাজার, মাঠ-ঘাটের সব জায়গাতেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক সামর্থ্যবান মানুষ মাটি খুঁড়ে তাদের নলকূপের নিচে ২০/২৫ হাজার টাকা খরচ করে ইঞ্জিন চালিত জলমটর বা সাবমার্সেল পাম্প বা এ জাতীয় মটর স্থাপন করে নলকূপের পানি সচল রাখছে। 

টিউবয়েল ব্যবসায়ী মনিনুর রহমান জানান, তাদের ঘরের শ্রমিকরা গ্রামাঞ্চলে নলকূপ বসিয়ে থাকে। সাধারণত ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার বা স্তর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন নলকূপ স্থাপন করতে গিয়ে ৩২ থেকে ৪০ ফুট নিচে পানির লেয়ার মিলছে। তবুও পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। 

এমন পরিস্থিতিতে কৃষিকাজে পরিকল্পিত সেচ কার্যক্রম চালানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সচেতন মহলের অনেকেই। মাঠে সেচকাজে ব্যাপকহারে সেচপাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার করায় সংকট বাড়ছে বলে অনেকে মনে করছে।  

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে পানির স্তর উদ্বেগজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে বলে মতামত তাদের। সুপেয় পনির সংকটে জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে শৈলকুপা হাসপাতালের ডাক্তার রাশেদ আল মামুন জানান, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার না করতে পারলে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়াসহ নানা অসুখে পড়ে। 

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঝিনাইদহের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম জানান, জেলাজুড়ে কত হাজার বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে নলকূপ রয়েছে তা তাদের পরিসংখ্যানে নেই। তবে সরকারিভাবে জেলায় ৩২ হাজার নলকূপ স্থাপন করা আছে। আর এসব নলকূপে পানির স্বাভাবিক অবস্থা রয়েছে। 

তিনি জানান, বিভিন্ন ফোরামে বা সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে তারা জানিয়েছেন, যাতে ডিজাইনমাফিক নলকূপ স্থাপনের আইন পাস হয়। প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে নলকূপ স্থাপন করলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট কমবে বলে তিনি পরামর্শ দেন।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়