সিলেটে অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে হামলার শিকার মেয়র-কাউন্সিলর
পরিবহন শ্রমিকেরা হামলা চালালে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে হেলমেট পরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান সহকর্মীরা
সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলের চৌহাট্টায় ফুটপাত ও সড়ক বিভাজক নির্মাণের জন্য মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারের অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে গিয়ে হামলার মুখে পড়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২ দফা সংঘর্ষে কাউন্সিলরসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা বন্দুক উঁচিয়ে মেয়র-কাউন্সিলরদের ধাওয়া করতে যান।
বুধবার বেলা একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় অবৈধ স্ট্যান্ডে রাখা মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কারসহ ১৯টি গাড়িতে ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ ১৬টি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। ঘটনাস্থল থেকে পরিবহনশ্রমিকদের পক্ষের বন্দুকধারী এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিলেটে চৌহাট্টা-আম্বরখানা সড়কের সংস্কারকাজ চলছে। এই সড়কের চৌহাট্টা-দরগাহ এলাকার ফুটপাত ও সড়কের অনেকাংশ দখল করে অনেক দিন ধরেই অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছেন মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারের শ্রমিকেরা। প্রতিদিন এখানে শতাধিক গাড়ি পার্কিং করা থাকে। চার দিন আগে এই অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে যান সিলেট সিটি করপোরেশনের একদল কর্মী। সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে এই অভিযানে বাধা দেন পরিবহনশ্রমিকেরা। পরে তাদের তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়ে এই সময়ের মধ্যে ফুটপাত ও সড়ক ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন মেয়র।
সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ দপ্তর সূত্র জানায়, আজ সকালে চৌহাট্টা এলাকায় সড়কের উন্নয়নকাজ বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন পরিবহনশ্রমিকেরা। এ খবর পেয়ে বেলা একটার দিকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে উন্নয়নকাজ পরিদর্শনে যান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি দেখতে পান, পরিবহনশ্রমিকেরা সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গাড়ি পার্কিং করে রেখেছেন। মেয়রসহ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে চাইলে তারা বাধা দেন। এ নিয়ে কথাবার্তার একপর্যায়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালান পরিবহনশ্রমিকেরা।
চৌহাট্টার বাসিন্দা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পরিবহনশ্রমিকদের হামলা ঠেকাতে সেখানে কর্মরত সিটি করপোরেশনের একদল কর্মী পাল্টা হামলা চালান। এ সময় স্ট্যান্ডে রাখা ১০টি মাইক্রোবাস, সাতটি প্রাইভেট কারসহ ১৯টি গাড়ি ঢিল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পুলিশের ওপরও হামলা চালান শ্রমিকেরা। চৌহাট্টা-আম্বরখানা, চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার, চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা-মিরবক্সটুলা সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনে এলোপাতাড়িভাবে ঢিল ছোড়া হয়। কেন্দ্রস্থলের পুরো এলাকায় তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
হামলার সময় ঘটনাস্থলে থাকা সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল আলিম শাহ জানান, মেয়র, কাউন্সিলর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে আলাপ করতে এসে পরিবহনশ্রমিকেরা অতর্কিত হামলা চালান। এ সময় একটি একনালা বন্দুক নিয়ে পরিবহনশ্রমিকদের পক্ষের একজন মেয়রের দিকে তেড়ে আসেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে শ্রমিকদের ছোড়া পাথরের ঢিলে আহত হয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদীসহ ১০ জন। পরিবহনশ্রমিকদের পাঁচজন আহত হয়েছেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়েছিলাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পরিবহনশ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণ আমাদের অবাক করেছে। মেয়র-কাউন্সিলর-ম্যাজিস্ট্রেট দেখেও তারা পাথর দিয়ে ঢিল ছোড়ে। একটি পাথর আমার পায়ে লাগায় আমি আহত হই। তারা বন্দুক উঁচিয়েও ধাওয়া করে।’
সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আবু ফরহাদ বলেন, পুলিশ আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৬টি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ফয়সল আহমদ ওরফে ফাহাদ (৩৮) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
চৌহাট্টার যে স্থানটি ঘিরে অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে ওঠেছে, সেটি সিভিল সার্জন ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ঘিরে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি সরকারি স্থাপনার সামনের অংশ দখলে থাকায় এর আগে একাধিকবার অবৈধ স্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক) অতিরিক্ত উপকমিশনার জ্যোতির্ময় সরকার। তিনি বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের পর আবার স্ট্যান্ডটি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। এ অবস্থায় ওই স্থান কোনোভাবেই দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না।
সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন চৌহাট্টা শাখার মাধ্যমে অবৈধ স্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। সংগঠনের চৌহাট্টা শাখার ‘কার-মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন’–এর সভাপতি অরুন দেবনাথ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আমাদের ওপর আগে হামলা চালিয়েছেন। হামলায় আমাদের পাঁচজন শ্রমিক আহত হয়েছেন। পরে তাঁরা ১৫-২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ অবস্থা ঠেকাতে গিয়ে সংঘর্ষ বাধে।’ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্ট্যান্ড খালি করার কথা বলা হয়েছিল কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সত্য যে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয়েছিল হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারের পাশে আমাদের সুবিধাজনক স্থানে ব্যবস্থা করা হবে। আমরা সমঝোতা চাইছিলাম। গাড়ি বেশি না হলেও কম যানবাহন নিয়ে স্ট্যান্ড রাখতে চেয়েছিলাম। স্ট্যান্ডে গাড়ি রাখা নিয়েই ঝামেলা হয়েছে।’
এ ঘটনায় হতবাক ও ক্ষুব্ধ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘অবৈধ স্ট্যান্ড বসিয়ে এ রকম হামলা, উন্নয়ন কাজে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা চরম ধৃষ্টতা। আমাদের ওপর বন্দুক নিয়ে হামলার চেষ্টা হয়েছে। এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। আমি চাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনুক। পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমি সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করে প্রতিকার চাইব। কেননা, সিটি করপোরেশন যে কাজটি করছিল, সেটি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এই কাজে বাধা দেওয়া বড় অপরাধ। এই অপরাধের মূলোৎপাটন দরকার।’
নিউজবাংলাদেশ.কম/এএস