ভিক্ষুক বেশি নিষিদ্ধ জোনেই!
ঢাকা: রাজধানীর গুলশান, বনানী এবং ধানমন্ডি ভিক্ষুকদের জন্য নিষিদ্ধ জোন হিসেবে পরিচিত। আইনানুযায়ী এই ৩ এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। গুলিস্থান বা মতিঝিলের মতো অফিস পাড়ার চেয়ে নিষিদ্ধ জোনেই ভিক্ষুকদের সংখ্যা বেশি। আর নিষিদ্ধ জোনে ভিক্ষা করতেই যেন ভিক্ষুকদের আগ্রহ তুঙ্গে।
শুক্রবার সকালে ‘ভিক্ষুক মুক্ত’ সাইনবোর্ড টানানো ৩টি এলাকা ঘুরে দেখা মিলেছে অন্তত শ’ পাচেঁক ভিক্ষুকের, যাদের বেশির ভাগই শক্ত লবিং করে টিকিট পেয়েছেন বিশেষ এই জোনের।
গুলশান ১ নম্বর থেকে একটু সামনে এগুতেই, অর্থাৎ ডিসিসি মার্কেটটির সামনেই দেখা মেলে অন্তত গোটাবিশেক ভিক্ষুকের।
মার্কেটের দিকে এগুতেই চারপাশ থেকে ৫-৭ জন ভিক্ষুক চেপে ধরলো সাহায্যের জন্য। এদেরই একজন জামেলা। বসয় চল্লিশের কোঠায়। স্বামী মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। তখন থেকেই তিনি ভিক্ষাবৃত্তির পেশায় আসেন। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে থাকেন টঙ্গীতে। জীবিকার সন্ধানে রোজ ঘড়ি ধরে সকাল ৮টায় চলে আসেন গুলশানে। আবার ফিরেও যান ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা ৭টায়। এ সময়ের মধ্যেই জামেলা অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা রোজগার করেন।
গুলিস্থান, মতিঝিল বাদ রেখে গুলশানে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামেলা বেশ হাসিহাসি মুখেই বললেন, ‘ওইসব জায়গায় ম্যালা মানুষ , কিন্তু ভিক্ষা পাওয়া যায় কম। দেখা যায় সারাদিনে হাজার খানেক টাকা কামাতেই জান বাইর হইয়া যায়। কিন্তু গুলশান এলাকায় অল্প সময়েই ম্যালা টাকা কামানো যায়। আর যদি কোনো বিদেশীর কাছে হাত পাতা যায়, তাহলে তো কথায় নাই।’
কিভাবে আসেন? ‘বহিন গুলশান ২ নাম্বারে ভিক্ষা করে। সেই আমারে এহানে ভিক্ষা করার ব্যবস্থা কইরা দিছে।’ জবাব জামেলার।
জামেলার ঠিক পাশেই লাল রঙের একটি বাটি নিয়ে ভিক্ষা করছেলেন মাজেদা আক্তার নামের প্রবীণ এক ভিক্ষুক, বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি আগেও গুলশান এলাকায় ভিক্ষা করতেন। পরে সরকার মাজেদাসহ এই এলাকার অন্য সব ভিক্ষুককে ময়মনসিংহের ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হলেও পরে তারা আবার রাজধানীতে ফিরে এসেছে।
গুলশান এলাকায় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভিক্ষুকদের অবাধ বিচরণ প্রসঙ্গে গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “গুলশান এলাকায় এখন আগের চেয়ে ভিক্ষুক অনেক কম। এখনও যারা এই এলাকায় ভিক্ষা করে, তারা মূলত বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করার আড়ালে ভিক্ষা করেন। আমরা ধরলেই বলে, ‘স্যার আমরা তো বাসা-বাড়িতে কাম করি।’ অথচ দেখা যায় পুলিশ চলে গেলেই তারা আবারও ভিক্ষা করতে শুরু করে।”
এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় ১ লাখেরও বেশি ভিক্ষুক রয়েছে। তবে এ তথ্য ২০১২ সালের। ওই বছর ১০টি এনজিও’র সহযোগিতায় একটি জরিপ চালায় ঢাকা সিটি করপোরেশন। সেই জরিপেই রাজধানীর ভিক্ষুকের ওই সংখ্যা উঠে আসে। জরিপে ভিক্ষুকদের পাঁচটি ক্যাটাগরি করা হয়।
ক্যাটাগরিগুলো ছিল মৌসুমি ভিক্ষুক, নিয়মিত ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক, নারী ভিক্ষুক ও শিশু ভিক্ষুক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালেই রাজধানীর ভিআইপি এলাকাকে (গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি) ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইনের আলোকেই এ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। যদিও সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিকের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকার কথা। সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস করে।
আইন অনুযায়ী, নিরাশ্রয়দের আশ্রয় দিতে গত বাজেটে ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পও হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের আওতায় নগরীর ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ চালানো হয়। জরিপের আওতায় এসব ভিক্ষুকদের মধ্য থেকে ২ হাজার ভিক্ষুককে ঢাকা, ময়মনসিংহ,বরিশাল ও জামালপুরে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বহুমুখি কর্মসংস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে ভিক্ষুকমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানী ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বা স্থাপনাগুলোকে ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ডিসিসি (দক্ষিণ) রাজধানীর হোটেল রূপসী বাংলা ও তার আশপাশের এলাকা এবং বেইলী রোড ও তদসংলগ্ন এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেছে।’ এ লক্ষ্যে গণমাধ্যমেও গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত বছর (২০১৪) ২২ জানুয়ারি সচিবালয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় রাজধানীর অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিমানবন্দর, হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী বাংলা, রেডিসন, বেইলী রোড এবং কূটনীতিক পাড়া ও দূতাবাস ভিক্ষুকমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া সরকার। এরই ধারাবাহিকাতায় প্রথমে গুলশান, বাননী এবং ধানমন্ডিকে ভিক্ষুকমুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়। পরে কয়েক দফা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী বাংলা এবং বেইলি রোডকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনএইচ/এফই
নিউজবাংলাদেশ.কম