রাজনৈতিকদের ব্যর্থতার ফল বিদেশিদের ‘প্রভূগিরি’
শাহেদ শফিক, স্টাফ রিপোর্টার
জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবিতে টানা অবরোধ ও হরতাল পালন করে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। জোটের কর্মসূচিতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। নির্মম মৃত্যুর শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অপর দিকে ২০ দলকে খুনি আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ বা সমঝোতা না করার সিদ্ধান্তে অটল আওয়ামী লীগ। দুই দলের এমন অনড় অবস্থানের কারণে নাগরিক সমাজের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিদেশিরাও।
এ অবস্থায় দুই দলের মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন জাতিসংঘসহ বিদেশী কূটনীতিকরা। কখনো কখনো তারা বসতে চেয়েছেন ‘প্রভূগিরির’ আসনেও। দেশের অভ্যন্তরীণসহ যেকোনও বিষয়ে বিদেশীদের প্রভূগিরির, হস্তক্ষেপ, মোড়লিপনার ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্টজনদেরও ক্ষোভ বেড়েছে। তবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও স্বাধীনচেতা জাতির মনে এমনটাই হওয়া উচিত বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
তারা বলছেন, অন্যান্য জাতিও যে এ ধরনের ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ইতিহাসে তারও ভুড়ি ভুড়ি স্বাক্ষ্য রয়েছে। এটা যে কোনো স্বাধীন দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব পরিপন্থি। কোনোভাবেই তা শুভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে না। আর এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না বাংলাদেশ।
তবে যেসব বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলোর কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ সে সব বিষয়ে ‘বন্ধু’ হয়ে মতামত দেয়ার অধিকার রয়েছে বিদেশীদের, কিন্তু অভ্যন্তরীন কোনও বিষয়ে নয়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
তারা জানিয়েছেন, পাকিস্তানীদের দাসত্ব ও জুলুম নিযাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীন সার্বভৌমত্ব আর্জন করেছে বাংলাদেশ। আর নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেই স্বাধীনতার অর্থ স্বার্থক হবে।
তারা এও অভিমত প্রকাশ করেছেন-- নিজেদেরে যে কোনও সমস্যা নিজেরাই সমাধাণ করতে পারাটাই স্বাধীনতার মূল প্রেরণা। বাঙালি জাতি নিজেদের স্বাধীনতার মূল স্বাধ গ্রহণ করতেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীন যে কোনও বিষয়ের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে না পারলে অচিরেই হয়তৈা পরাধীন কোনও জাতিতেই পরিণত হবে এ জাতি। স্বাধীন কোনও ভূ-খণ্ডে কোনও বিষয়ে অন্য কোনও দেশের মাতবরি স্বাধীনতার পরিপন্থি।
তাদের মতে-- কিছু অন্যায় আবদার যে বিদেশীরা করবে না তা না। কিন্তু সে অন্যায় আবদার করার মতো আমাদেরকেও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবেই তারা আর আমাদের কোনও বিষয়ে নাক গলাবে না। আর এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় দেশের নেতা ও নীতিনির্ধারকরা নিজেরা যদি দক্ষ ও যোগ্য হন তবে এ ধরনের অযাচিত চাপ সহ্য করার শক্তি না থাকার কোনো কারণ নেই।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবন্ধ সেসব বিষয়ে বিদেশিরা মাতবরি বা মতামত দিতে পারে এটা তাদের অধিকার রয়েছে। কারণ আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলোর কাছে চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীন বিষয়ে তখনই তারা কথা বলার সাহস পায় যখন আমরা নিজেরা ব্যর্থ হই। এসব বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের পেছনে আমাদের ব্যর্থতাই দায়ী।’
তিনি এও বলেন যে, নিজেদের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব রাখা হয় তাহলে কোনও সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যদি যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় না দেয়া যায় তাহেল বিদেশিরা হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেই। নিজের পরিবারের কোন্দল মেটানোর জন্য যদি প্রতিবেশীকে ডাকা হয়, তাহলে তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সহজ রাস্তা পেয়ে যায়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর রাতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের রাজনৈতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় আসেন। টানা ৫ দিনের সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, জামায়াতে ইসলামী, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠককালে তিনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে বৈঠকে বসার তাগিদ দেন।
একই সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং দুই দিনের সফরে গত ৪ ডিসেম্বর বুধবার ঢাকায় আসেন। এসময় তিনি সবকটি দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। এর পরে ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় আসেন বৃটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সিনিয়র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ারসি। এর আগেও তিনি ওইবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একই বিষয়ে ঢাকায় আসেন। সেসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে বৈঠক করেন।
একই বিষয়ে গত বছরের ১৬ নভেম্বর তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। এসময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংকট ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন।
একইভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনসহ বিদেশি হেভিওয়েরট নেতারা টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তখন তারা সবাই দেশের এমন পরিস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন।
তবে নির্বাচরে ঢাকা কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই ফিরে যান তারানকো। ফলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই ১৫৪টি আসনে কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ক্ষমতাসীনরা নিজেদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এ ধরনের অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ।
তবে তারানকোর ওই সফরে সংবিধান রক্ষার একটা নির্বাচন করে সংসদ ভেঙে দিয়ে আবার নির্বাচন দেয়ার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিলো বলে দাবি বিএনপির। কিন্তু তা অস্বীকার করছে আওয়ামী লীগ। অঙ্গীকার অনুযায়ী আবার নির্বাচনের দাবিতে সংগ্রাম-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির চলমান আন্দোলনে পেট্রোল বোমা ও সহিংসতায় দিনদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। অচল হতে চলেছে দেশের অর্থনীতি। চলমান সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান।
এ অবস্থায় দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছার জন্য আবারো বাংলাদেশে আসছেন তারানকো।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তারানকোর বাংলাদেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারানকোকে।
তারানকোর মতো বিদেশী কূটনৈতিকের আগমনকে ইতিবাচক দেখলেও হতাশা ব্যক্ত করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম সামছুল হুদ। শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে পারি। আমরা কেন আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবো না? বিদেশীদের আসা কাম্য না। রাজনীতির মধ্যে শেষ বলতে কিছুই নেই। আমরা পারবো।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এর চেয়ে বড় লজ্জা হতে পারে না। কিন্তু এছাড়াও হবে না। কারণ, আমরাতো কেউ কাউকে মানুষ বলে গণ্য করি না। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হয় সবার জন্য বিপদ।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এটা কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারে না। তবে গ্লোবাল বিজনেসের কারণে কিছু কিছু বিষয়ে রয়েছে যে বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের স্বার্থ সম্পৃক্ত সে সব বিষয়ে তাদের বলার অধিকার রয়েছে। তবে আমাদের অভ্যন্তরীন যে কোনও বিষয় নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে পারেন না। এ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য আমরাই দায়ি।’
একে/
নিউজবাংলাদেশ.কম