রেললাইনের নকশার স্থানে রাতারাতি পাকা ভবন!
খুলনা: খুলনা- মংলা রেললাইনের নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকার জমির মালিকেরা রেললাইনের নকশাকৃত জমির উপরই রাতারাতি গড়ে তুলছেন পাকা ভবন। অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার লোভে তারা রাতারাতি ভবন নিমার্ণ শুরু করেছে। ফলে নকশা পরিবর্তনের আশংকা দেখা দিয়েছে। এই কাজে প্রশাসন ও রেলের কর্তাব্যক্তিদের জড়িত থাকারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন- রেল লাইন যে স্থান দিয়ে যাবে সেখানকার নকশা হয়েছে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমি চিহ্নিতও করা হয়েছে। তাহলে সে সকল স্থানে কিভাবে জমির মালিকেরা রাতারাতি বাড়িঘর নির্মাণ করছে? এ নির্মাণ কাজ কেন বন্ধ করা হচ্ছে না?
খুলনা-মংলা রেল লাইনের ফুলতলা রেলষ্টেশন থেকে মংলা খুলনা রেললাইনটি শুরু হবে। সেখানে পাহারারত আনসার সদস্য মোবারেক শেখ নিউজবাংলাদেশকে বলেন, মাস দুয়েক থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। স্যারেরা লাল ফ্ল্যাগ পুতে রেল লাইনের জায়গা চিহ্নিত করেছে। সেই চিহ্নিত জায়গায় জমির মালিকেরা নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করছে। ফাঁকা বিলের মধ্যেও পাকা বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে।
রেল কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত নকশা অনুযায়ী বিলডাকাতিয়ায় মধ্যে পাকা ভবন নির্মাণকারী শিরোমনি এলাকার বাসিন্দা আকরাম হোসেন (৬০)। রেললাইনের নির্মাণের জন্য তাঁর প্রায় ৪ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেই জমিতে পাকা ভবন নির্মাণ করছেন তিনি।
ভবন নির্মাণ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, জমির মূল্য বাবদ যে টাকা দেওয়া হবে তার শতভাগ টাকা ক্ষতিপুরণ হিসেবেও দেয়া হবে। আবার স্থাপনা থাকলে টাকা আরও বেশি পাওয়া যাবে। তাই ঘর নির্মাণ করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জমির মালিক বলেন, ক্ষতিপূরণ বেশি পেতেই ভবন নির্মাণ করছি। প্রশাসনের লোকদের পরামর্শেই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ অতিরিক্ত অর্থের একটি অংশ প্রশাসনের লোকজনকে দিতে হবে।
নকশা সংশ্লিষ্ট জমিতে পাকা ঘর নির্মাণকারী মো. কিবরিয়া বলেন, আমাদের প্রায় আড়াই একর জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। শুনেছি জমির মূল্য ও ক্ষতিপূরণ বাবদ শতক প্রতি অনেক টাকা দেয়া হবে। তাছাড়া পাকা ঘর থাকলে জমির মূল্য ও ক্ষতিপূরণ কয়েকগুণ হবে। তাই পাকা ঘর নির্মাণ করছি।
ওই স্থানে দোতলা ভবন নির্মান করছেন মো. মশিউর রহমান। সেখানে কর্তব্যরত মিস্ত্রীরা জানান, রাতের বেলায়ও কাজ করতে হচ্ছে। এ জন্য মালিক অতিরিক্ত টাকা দেবেন বলে জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন (জিওবি) ও ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় এই রেলপথটি নির্মিত হবে। এরইমধ্যে রেললাইনের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। রূপসা নদীর উপরে হযরত খানজাহান আলী সেতুর দেড় কিলোমিটার দূরে যুক্ত হবে রেল সেতু।
সূত্রমতে, প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্য মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালে ৩০ জুন। প্রকল্পটির ৩টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি রেল সেতু, অপরটি রেল লাইন এবং অন্যটি টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিং।
প্রকল্পের অধীনে ৮৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ৬৫ কিলোমিটার হবে মেইন লাইন এবং ২০ কিলোমিটার হবে লুপস, ইয়ার্ড এবং সাইডিং। এর মধ্যে ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রেল সেতু হবে। খুলনা ফুলতলা থেকে শুরু করে রেললাইনটি বাইপাস সড়কের পশ্চিম হয়ে রূপসা সেতুর দক্ষিণ পাশ দিয়ে কাটাখালি এবং সেখান থেকে মংলা পর্যন্ত যাবে। ফুলতলা থেকে মংলা পর্যন্ত ৮টি স্টেশন হবে। স্টেশনগুলো হলো- ফুলতলা, আড়ংঘাটা, মোহাম্মদ নগর, কাটাখালী, চুলকাটি, ভাগা, দিগরাজ ও মংলা। স্টেশনে ও মংলা পোর্ট অভ্যন্তরে মালামাল পরিবহনের জন্য ২টি সংযোগ লাইন যুক্ত করা হবে।
প্রকল্পের খুলনা অংশের ৪শ’ একর, বাগেরহাট অংশের ২৭৮ একর এবং পোর্ট এলাকার ৭৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। এতে ২১টি ছোট আকৃতির ব্রীজ ও ১১০টি কালভার্ট নির্মিত হবে।
এ বিষয়ে খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ ) মো. সুলতান আলম নিউজবাংলাদেশকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী জমির মালিকদের জমির মূল্য ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তিনি বলেন, রেল লাইনের নকশা অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ ও যাচাই বাছাই করা হয়েছে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার চিত্র গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো স্থাপনা তৈরি হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল জানান, জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। চলতি মাসেই জমির মালিকদের টাকা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০১২ সালের ১৪ জুন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা প্রণয়ন, দরপত্র আহ্বান এবং নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পরে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পায় ভারতের কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স গ্রুপ লিমিটেড ও নিপ্পন কোয়েই ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এসএইচ/এফই
নিউজবাংলাদেশ.কম