শরীরে পোড়া ক্ষত, মনে আতংক
ঢাকা: ইকবাল হোসেন। বয়স চল্লিশের কোটায়। পেশায় ট্রাক চালক। শরীরের অর্ধেকাংশ সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া। শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ভবনের ৪র্থ তলার ১১ নম্বর পেন বেডে। মাঝে মাঝেই কেন যেন নিজের অজান্তেই আঁতকে উঠছেন ইকবাল হোসেন। বিড়বিড় করে বলছেন, ক্যামনে এই কিস্তি শোধ করুম, ক্যামনে পোলা আর ছোট ভাইডার পড়াশোনার খরচ চালামু।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায় এমনই এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। শুধু ইকবালই নয়, ইউনিটে এখনও কাতরাচ্ছেন অন্তত শ’ খানেক দগ্ধ রোগী।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইকবাল জানান, ৫ মার্চ বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার সময় তিনি ভালুকা থেকে মাল লোড করে ট্রাক নিয়ে মানিকগঞ্জ আকিজ গ্রুপের ফ্যাক্টরির দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ফ্যাক্টরি থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরে ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তেরই আগুন ধরে যায় পুরো ট্রাকে। ধোঁয়াই অন্ধকার হয়ে যায় চারপাশ। এরমধ্যেই খুব কষ্টে হেলপার ও লেবারকে নিয়ে ট্রাকের গ্লাস ভেঙে লাফ দেন ইকবাল হোসেন।
অবশ্য, লাফ দিয়েও রেহাই পাননি তারা কেউই। পেট্রোলবোমার আগুনে ইকবাল হোসেন এবং হেলপার সুমনের শরীরের অন্তত ২০ ভাগ পুড়ে গেছে। লেবার কালামের শরীরেরও পুড়েছে প্রায় ১০ ভাগের মতো। কিন্তু ইকবাল হোসেন এখনো চিকিৎসাধীন থাকলেও বুধবার দুপুরে সুমন এবং কালামকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয় বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। ইকবালের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুমনের শরীরেরও ২০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। শরীরে ব্যান্ডেজ থাকা অবস্থাতেই তাকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
সুমন ও কালামকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়ে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পালের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নিউজবাংলাদেশকে বলেন, ‘তাদের দু’জনের (সুমন এবং ইকবাল) শরীরের পোড়া ক্ষত সমান হলেও সুমনের শারীরিক অবস্থা বেশ ভালো। তাই তাকে গতকাল ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে যে কোনো সমস্যা হলে তারা চাইলেই চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। এ জন্য সুমন ও কালামকে চিকিৎসকদের ফোন নম্বরও দেয়া হয়েছে।’
‘বাড়িতে কি তারা হাসপাতালের মত চিকিৎসা পরিবেশ পাবেন?’ এমন এক প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিস্ট বিভাগের আবাসিক সার্জন বলেন, ‘না সেটা কখনোই সম্ভব না। কিন্তু আপনারাতো আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানেন। এমনিতেই এখন এই ইউনিটটিতে চলছে চরম লোকবল সংকট, তারওপর যদি বেড সংকট দেখা দিলে নতুন রোগী কোথায় রাখবো।’
পরে একই বিষয়ে জানতে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অবৈতনিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনের সাথে যোগযোগ করা হলে তিনিও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘দগ্ধ রোগীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হলো শ্বাসনালী। কারণ এমন অনেক দগ্ধ রোগী দেখা যায়, যাদের শরীরে দগ্ধ হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ। কিন্তু এর মধ্যে তাদের শ্বাসনালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন রোগীকে বাঁচানো অনেক কঠিন বিষয় হয়ে যায়। সুমন ও কালামের শ্বাসনালীতে কোনো আঘাত নেই। তাই তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
ইকবাল হোসেনের মাথার কাছে বসে থাকা তার খালাতো ভাই গোলাম মোর্শেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার উথরা গ্রামের কে বি এম আলী হোসেনের বড় ছেলে। পরিবারে রয়েছে বৃদ্ধ মা, ছোট ভাইসহ আরো ৩ বোন। ইকবাল হোসেনের একটি ছেলেও আছে, যার নাম শিপন। সে ৩য় শ্রেণির ছাত্র।
এদিকে ইকবাল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া ট্রাকটি তিনি আট মাস আগে কিস্তিতে কিনেছেন। এখন পর্যন্ত মোট ৬০টি কিস্তির মধ্যে দেয়া হয়েছে ৮টি। বাকি রয়েছে ৫২টি কিস্তি, যার প্রত্যেকটিতে দিতে হবে ৩৮ হাজার টাকা। চলতি মাসের কিস্তিটি এখনো পরিশোধ করতে পারেননি ইকবাল। আর কীভাবেই বা পারবেন, তিনি তো দিন-রাত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পোড়া যন্ত্রণায় কতরাচ্ছেন।
বার্ন ইউনিটের তথ্যমতে, অবরোধ-হরতারের ৬৫ দিনে পেট্রোলবোমা ও বিভিন্ন সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয় ১৩৬ জন। এর মধ্যে নয় জন মারা গেছেন। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন ৬০ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্যদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ঢামেকের তৃতীয় তলার কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান বার্ন ইউনিটের পরিকল্পনা পরিচালক ডা. আবুল কালাম। এসময় এই ইউনেটর অবৈতনিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল, ঢামেক পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
পুলিশের তথ্য মতে,লাগাতার এ অবরোধে বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে ৩৬ জনসহ সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১১৯ জন; আহত ব্যক্তির সংখ্যা সহস্রাধিক। আগুন দেওয়া হয়েছে অন্তত ১২শ’ টি যানবাহনে এবং ভাঙচুর করা হয়েছে ৬৩৯টি যানবাহন; রেলে নাশকতা হয়েছে ১৪ দফায়।’
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলতি বছরের গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। তবে এর দুই দিন আগেই শুরু হয় সহিংসতা। হিসেব মতে আজ এই কর্মসূচীর ৬৭তম দিন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনএইচ/
নিউজবাংলাদেশ.কম