ছোটদের শঙ্খ ঘোষ
বড় হওয়া কি সত্যি ভুল! একবার বড় হয়ে গেলে কতোকিছু হারিয়ে যায় জীবন থেকে। মানুষের আয়ুও ফুরিয়ে যায়। কবি শঙ্খ ঘোষও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার ‘বড় হওয়া খুব ভুল’ বই থেকে ‘পানসুপুরি’ ছড়াটি মনে করিয়ে দেয় শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলোর কথা।
তিনি কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও ছিলেন সমান পারদর্শী। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পরবর্তী সময়ে বাংলা আধুনিক কবিতার পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম পাণ্ডব ছিলেন তিনি।
কবি শঙ্খ ঘোষ এর আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তার বাবার নাম মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মায়ের নাম অমলা ঘোষ। তিনি অবিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। কবির পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়ায়। কিন্তু বাবার কর্মসূত্রে শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। তিনি পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। দেশভাগের পর কবিরা কলকাতা চলে যান। কিন্তু বাংলাদেশের টান তার মনের গভীরে থেকে যায়। তিনি লিখেন-
শঙ্খ ঘোষ ছোটদের জন্যও অসাধারণ সব ছড়া-কবিতা লিখেছেন। চলো পড়ে নিই সেরকম একটি মজার পদ্য-
আমরা যখন ছোটো ছিলাম কতই বয়স হবে
কেউবা ছিলাম কৈশোরে কেউ নিতান্ত শৈশবে
পুজোর ছুটির শেষে যখন দেশের বাড়ির থেকে
খাল পেরিয়ে নৌকো যেত নদীর দিকে বেঁকে
আমরা কেউ-বা ছইয়ের ওপর কেউ-বা পাটাতনে
বসে বসে ভেবে যেতাম কোন খানে কোন কোণে
রইল পড়ে টান আমাদের রইল পড়ে প্রাণ
ঝপসা থেকে ঝাপসা হয়ে আসছে যখল গ্রাম
তখন দেখি একটা ছবিই জাগছে ফিরে ফিরে
ঠাকুরমা দেন পানসুপুরি ঠাকুরদা দেন চিড়ে
আর সকলই চোখের থেকে মিলিয়ে যায় ধীরে
রইল শুধু পানসুপুরি রইল শুধু চিড়ে।
মিথ্যে কথা
লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা, দেখো নৃত্যনাট্য”-যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয়, “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
“জানিস? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে !”
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন “শোন,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।”
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব-
আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।
হারিয়ে-যাওয়া দেশ
বললে এটা ভুল হবে কি
যখন কোনো স্বপ্ন দেখি
তখন কেবল তোমার মুখই ভাসে
যখন থাকি আপনমনে
কিংবা আধো জাগরণে
তখনও তো আমায় ছাড়ে না সে।
একটা-দুটো গল্পকথা
বলতে গেলে তোমার ছটা
লাগেই এসে সে-গল্পটার গায়ে
বলছি তোমায় এসো এসো এসো
আমার তুমি সব নিয়েছ
ডাইনে তুমি তুমিই আছো বাঁয়ে।
তুমি আমার ভৈরবী গান
কিংবা ভোরে খোলা আজান
জলের কোলে সারিগানের রেশ-
তুমি আমার চিরকালীন
একলা থাকার দুঃখতে লীন
তুমি আমার হারিয়ে-যাওয়া দেশ!
আরাম
ঘুম ভেঙে দেখি আজ
পাখিদের কূজনে
বাবা আছে মা-ও আছে
দুই পাশে দুজনে।
ওই ঘরে ঘুমভরে
জিজি আছে বেঘোরে
পুতুলেরা টুংটাং
নেচে ওঠে এ ঘরে।
এদিকে আজান আর
ওইদিকে সিয়ারাম
সব আছে ঠিকঠাক
আঃ! আজ কি আরাম!
কবি ১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯৫১ সালে একই কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক পাশ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকাত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন অধ্যাপনাকেই। পড়িয়েছেন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শিশু-কিশোরদের জন্য কবি অসংখ্য বই লিখেছেন। যেমন- বিদ্যাসাগর (১৯৫৬), সকালবেলার আলো (১৯৭২), শব্দ নিয়ে খেলা: বানান বিষয়ক বই (কুন্তক ছদ্মনামে লেখা- ১৯৮০), রাগ করো না রাগুনী (১৯৮৩), সব কিছুতেই খেলনা হয় (১৯৮৭), সুপুরিবনের সারি (১৯৯০), আমন ধানের ছড়া (১৯৯১), কথা নিয়ে খেলা (১৯৯৩), সেরা ছড়া (১৯৯৪), আমন যাবে লাট্টু পাহাড় (১৯৯৬), ছোট্ট একটা স্কুল (১৯৯৮), বড় হওয়া খুব ভুল (২০০২), ওরে ও বায়নাবতী (২০০৩), বল তো দেখি কেমন হত (২০০৫), অল্পবয়স কল্পবয়স (২০০৭), আমায় তুমি লক্ষ্মী বল (২০০৭), শহরপথের ধুলো (২০১০), সুর সোহাগী (২০১০), ছড়া সংগ্রহ (২০১০), ছোটদের ছড়া কবিতা (২০১১), ইচ্ছে প্রদীপ (২০১৪), ছোটদের গদ্য (২০১৭) ও আজকে আমার পরীক্ষা নেই (২০১৮) ইত্যাদি।
শঙ্খ ঘোষ ২০১১ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে ১৯৭৭-এ ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নরসিংহ দাস পুরস্কার, ওই বছরই ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার; ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার; ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ এর জন্য সরস্বতী পুরস্কার পান। এছাড়া ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মান লাভ করেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি