আন্তর্জাতিক মানের সংগঠন হবে এফবিসিসিআই
এফবিসিসিআইকে একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায়ী সংগঠনে রূপ দিতে পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলুব আহ্মদ। নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে দুই বছরের ছুটি নেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
আসন্ন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন দেশের মোটরগাড়ি ব্যবসার এই আইকন।
এবারের নির্বাচনে চেম্বার গ্রুপ থেকে (রাজশাহী চেম্বার) থেকে সভাপতি হিসেবে প্রার্থী হবেন তিনি। ২০১৫-১৭ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন চলতি বছরের মে মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হবে। এরইমধ্যে অধ্যাপক আলী আশরাফকে চেয়ারম্যান করে নির্বাচন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নতুন মেয়াদের জন্য সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবেন চেম্বার গ্রুপ থেকে। আর প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হবেন অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে।
সম্প্রতি এই নির্বাচন ও ব্যক্তি জীবন নিয়ে নিউজবাংলাদেশের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন আব্দুল মতলুব আহ্মদ। তার সঙ্গে আলাপ করেছেন নিউজবাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ শিশির।
নিউজবাংলাদেশ: আপনার ব্যক্তি জীবন ও ব্যবসায় উদ্যোগী হওয়ার বিষয়ে বলুন?
মতলুব আহ্মদ: ১৯৭২-৭৩ সালে ব্যবসা শুরু করি। আমার ব্যবসায়ীক জীবন চার দশক হয়ে গেছে। ছাত্র জীবন থেকেই আমাকে ব্যবসায় নামতে হয়েছিল। কারণ সাড়ে ১৭ বছর বয়সে বাবা মারা যান। পরিবারে আমাদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪ জন। দেখলাম চাকরি করে এত বড় পরিবার চালানো সম্ভব হবে না। তাই পরিবারের সবাই ব্যবসায় নেমে গেলাম। প্রায় সব ধরনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা আছে। পরে আমার পছন্দের বিষয় মোটরগাড়ির ব্যবসায় মনোনিবেশ করি।
নিউজবাংলাদেশ: মোটরগাড়ির ব্যবসা কবে থেকে?
মতলুব আহ্মদ: যখন আমরা পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, যে যার মতো ব্যবসা করবো। তখন ১৯৮১ সাল। আমি নিটল মোটর দিয়ে যাত্রা শুরু করি। এখন গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে, যন্ত্রাংশ উৎপাদন, রপ্তানি, অ্যাসেম্বলিং, সার্ভিসিং, বিক্রি ও মোটরগাড়ি সংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের কাজই হচ্ছে।
নিউজবাংলাদেশ: ব্যবসা পরিচালনায় প্রধান কোন বিষয়টিকে সমস্যা মনে করছেন?
মতলুব আহ্মদ: আমি দেশের অনেক ব্যবসায়ী নেতা, চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ইতিমধ্যে বৈঠক করেছি। তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনেছি। সব জায়গায় একই আওয়াজ। তা হচ্ছে ব্যাংকের সুদের হার বেশি। তাই আমার প্রথম কাজ হবে ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ করা। এ বিষয়ে আমি এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আমার কাছে সে ফরমুলা চলে আসছে। ইনশাআল্লাহ আমরা খুব তাড়াতাড়ি ৯ শতাংশে নিয়ে আসতে পারবো।
বর্তমানে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের হার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর এ উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মুনাফা করতে হবে, যা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, হরতাল-অবরোধে যে ক্ষতি হয়েছে তা অনেকে চিহ্নিত করেছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের মধ্যে সরকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে। যাদের ব্যবসা ৫০০ কোটির ওপর। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। এটা ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য দিতে হবে। সেটা এমন হতে পারে, চলতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় ৮০ বা ৯০ দিনে যে সুদ এসেছে তা মওকুফ করে দিতে হবে। এমনও হতে পারে, যেসব অ্যাকাউন্ট ডিফল্ট হয়েছে, তার যে শ্রেণিকরণ (তালিকা) করা হয় তা যেন আগামী ছায় মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়। কারণ ডিফল্ট হলেও যাতে ব্যবসা করে যেতে পারে। আর এ সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকে করে দিতে হবে। এগুলো জরুরি।
নিউজবাংলাদেশ: নির্বাচিত হলে এফবিসিসিআই সদস্যদের কল্যাণে কী ধরণের উদ্যোগ নেবেন?
মতলুব আহ্মদ: প্রত্যেক সদস্যের বসার জন্য আলাদা কক্ষ করে দেব। যাতায়তের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকবে। জেলা শহরে থেকে যারা আসেন তাদের জন্যও এ ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া সিআইপি মর্যাদার ব্যবহার ও ব্যবসার কাজে মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের সহজ ব্যবস্থা করা হবে।
নিউজবাংলাদেশ: সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। অভিন্ন পদ্ধতির ভ্যাট আদায়ের বিষয়ে আপনার কোনো আপত্তি আছে?
মতলুব আহ্মদ: আমি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভ্যাট দাতাদের মধ্যে একজন। আইনের বিষয়ে আমার মতামত হলো- আমি অভিন্ন ভ্যাট পদ্ধতির পক্ষে। কারণ যখন একজন ভ্যাট দাতা বিভিন্ন ধরনের (স্তরের) ভ্যাট দেন; সেক্ষেত্রে এনবিআরের লোকজনের শক্তি বেড়ে যায় এবং তারা আমাদের উপর চড়াও হয়ে যেতে পারে। আর অভিন্ন ভ্যাট পদ্ধতি থাকলে ব্যক্তি নিজেই নিজের ভ্যাট দেবে, কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। তবে অভিন্ন পদ্ধতিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ হবে না, এটি হতে হবে ৪ শতাংশের মধ্যে। তাহলে চুরি করার প্রবণতা কমে যাবে এবং আমরা সরকারকে সবাই ভ্যাট দেব। ফলে এখন যে ভ্যাট সরকার পাচ্ছে, তার চাইতে বেশি পাবে।
নিউজবাংলাদেশ: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সুনাম রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এলসি জটিলতায় ক্রেতাদের সঙ্গে সমস্যা দেখা দেয়। এর জন্য দায়ী কে? ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায় কীভাবে সফলতা পেতে পারেন?
মাতলুব আহ্মদ: বিদেশিদের সঙ্গে কোনো ভাঁওতাবাজি করা যায় না। শতভাগ সততা নিশ্চিত করতে হয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা ভালো কাজ করতে চান, কিন্তু মাঝে মধ্যে কারো কারো এদিক ওদিক করার প্রবণতা থাকে। বিদেশি ক্রেতাদের স্বার্থ দেখলে ওরাও মানসম্মত মনোভাব দেখায়। তখন এক সঙ্গে ব্যবসা করেও আনন্দ পাওয়া যায়।
অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করে এলসি পেমেন্ট বন্ধ করেছে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। যারা এ পথ অবলম্বন করেন তাদের হয়তো সাময়িক লাভ হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এ জন্য সততা ও নিষ্ঠা উভয় পক্ষের জন্যই ব্যবসার জন্য ভালো।
নিউজবাংলাদেশ: ব্যবসায় সরকারের কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
মতলুব আহ্মদ: শুরু থেকে আমি সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। বর্তমানে বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকিং সেক্টর ব্যবসায়ীদের জন্য এগিয়ে এসেছে। তবে আমাদেরকে দায়িত্বশীল হতে হবে, সৎ হতে হবে। ব্যাংকের টাকা জনগণের, যথাসময়ে তা ফেরত দিতে হবে। বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে।
নিউজবাংলাদেশ: স্বাধীনতার পর থেকে ব্যবসা শুরু করেছেন, দীর্ঘ সময়ের ব্যবসায় রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে আগের পরিস্থিতির কোনো মিল আছে কি?
মতলুব আহ্মদ: রাজনৈতিক সমস্যা আমাদের দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে থাকবেই। কোনো দেশের জন্মের পর প্রথম ৫০ থেকে ১০০ বছর এভাবেই কেটে যায়। খোদ আমেরিকায় সবার পকেটে পিস্তল থাকে। একজন আরেক জনকে সমস্যা মনে করলেই গুলি করে দেয়। আমদেরতো সে অবস্থায় যায় নাই। আমাদের নতুন জাতি, নতুন দেশ। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যে লক্ষ্য, তা এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে এটা খুব দুঃখজনক, যারা রাজনীতি করেন তারা দেশের অর্থনীতিকে সামনে আনছেন না। তারা যদি দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে না পারেন, তা হলে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই আন্দোলন কর্মসূচির অন্য কোনো পদ্ধতি বের করা উচিৎ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো সবার আগে দেশ।
নিউজবাংলাদেশ: দেশের পুঁজিবাজার বিষয়ে কিছু বলবেন?
মতলুব আহ্মদ: পুঁজিবাজার নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ যারা পুঁজিবাজার বোঝেন, যারা কাজ করেন, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজারে যাদের স্বার্থের হানি হচ্ছে, তারা যদি দলগতভাবে আমার কাছে আসেন, তাদের সমস্যা তুলে ধরেন, নিশ্চই এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে কিছু করার থাকলে করবে। এ জন্য পুঁজিবাজারের বিষয়ে আমি আগাম কিছু বলতে চাই না।
নিউজবাংলাদেশ: ভোটারদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
মতলুব আহমদ: আমার জীবনের বহু বছর কেটে গেছে। আমি এতদিন ব্যবসা করেছি। আমি নিজের জন্য কাজ করেছি, আয় করেছি, টাকা আমার কাছে ছিল। আমি দুই বছর ছুটি নিচ্ছি আমার গ্রুপের দায়িত্ব থেকে। এ দুই বছর আমি ব্যবসায়ীক সমাজের জন্য কাজ করবো। ব্যবসায়ীদের উন্নয়ন ও উন্নতির জন্য কাজ করবো। বিজয়ী হলে আমার সঙ্গে যারা থাকবেন তাদেরও একই ভাবে থাকতে হবে। তারা হয়তো দুই বছর সময় দিতে পারবে না, তবে তাদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে। এফবিসিসিআইকে অতীতে অনেকে অনেক কিছু বলেছে, আগামীতে যাতে শুধু ভালোই বলে তার ব্যবস্থা আমি করবো।এ প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মানের সংগঠনে রূপ দিতে যা করার তাই করব।
নিউজবাংলাদেশ.কম/জেএস/এজে
নিউজবাংলাদেশ.কম