বাজেট আরও সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন ছিল: বিসিআই
বৈশ্বিক করোনা (কোভিড ১৯) পরিস্থিতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে রূপরেখা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে তা যথেষ্ট নয়, এটি আরও সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাষ্ট্রিজ (বিসিআই)।
প্রস্তাবিত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের উপর এক প্রতিক্রিয়ায় শনিবার দুপুরে বিসিআই এ মন্তব্যে করে।
বিসিআইয়ের মহাসচিব মোস্তফা মহিউদ্দীনের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞতির মাধ্যমে আজ দুপুরে সংগঠনটির সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) প্রস্তাবিত বাজেটের উপর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রস্তাবে বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সেজন্য বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এই বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস ও প্রাণিসম্পদ, খাদ্য নিরাপত্তা খাতসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রণোদনা অনেকগুলি সংশ্লিষ্ট খাতে অর্থ বরাদ্দ বেশি রাখা হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
তবে বিসিআই মনে করে, যে বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে রূপরেখা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে তা যথেষ্ট নয় আরও সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন ছিল। করোনা মহামারীর কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান আজ এক মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। শুধু পোশাকশিল্প নয় স্বল্প পুঁজির কল কারখানা সচল রাখা এবং এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা ও দক্ষ কর্মী সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা অতি জরুরী যেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকা প্রয়োাজন।
প্রস্তাবিত বাজেটে, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয় সীমা ৩ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, সর্ব নিম্ন কর ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ করের সীমা ২৫ শতাংশ করায় অর্থমন্ত্রীকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি, যা বিসিআইয়ের বাজেট প্রস্তাবের প্রতিফলন।
করপোরেট কর কমানোর কারণে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিছুটা লাভবান হবে নিঃসন্দেহে তবে করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি টিকে থাকার জন্য শিল্প ক্ষেত্রে কর্পোরেট করের হার হ্রাস করার করার অনুরোধ করছি। ভ্যাট রিটার্ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ অনলাইন করা, রিফান্ড পদ্ধতি সহজীকরণ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ধারা অনুযায়ী ভ্যাট, শুল্ক ও অগ্রীম কর ২ মাসের মধ্যে রিফান্ড করার প্রস্তাব করছি।
দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানি করার ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ ও অগ্রিম কর সমন্বয় করার জন্য দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয় করার সুযোগ দেওয়ার হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে, বিসিআই কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর প্রত্যাহ্যার করার প্রস্তাব করছে।
বাজেটে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে তাও অনেক উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয় এটা আরো বাস্তবভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন। বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, এ ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের কথা বলেছে। সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বাজেটের ১১.২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা এই মুহূর্তে অতিব জরুরী নয় এ খাতে বরাদ্বকৃত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করে এমনসব প্রণোদনা প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত হলেই বেশি জনকল্যাণমুখী হতো। করোনা কারণে অনেকে এখন শহর থেকে গ্রামে মাইগ্রেট করেছে। গ্রামীণ বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন বেশি প্রয়োজন সেদিকে নজর দিয়ে কৃষি ও কুটির শিল্প নির্ভর গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় করার লক্ষ্যে বিশেষ স্কিম নেয়া যেতে পারে। আর্থিক প্রণোদনা সহ করোনা স্বাস্থ্যঝুঁকি সময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রণোদনা অনেক বেশি গ্রামীণ অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চালন করবে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রনোদনার ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ করছি।
বর্তমান বাজেটে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যয় ন্যায্য ভিত্তিক ও বিচক্ষনতার সহিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কে বেশি অগ্রাধিকার দিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেক্টরকে সম্পৃক্ত করে একটি অভিন্ন নীতিমালা এনে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য করার বিষয় মাথায় রেখেই এ খাতে বরাদ্দ সুচারুরূপে ব্যয় করতে হবে বলে বিসিআই বিশ্বাস করে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের ১৫.১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে বৃহৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কল কারখানার কর্মীদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। বাজেটে অর্থ ব্যয় কালে এ বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা থাকা প্রয়োজন বলে বিসিআই মনে করে।
বিসিআই সভাপতি বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাজেটের দিক নির্দেশনাগুলো স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী হওয়া উচিৎ, যা প্রস্তাবিত বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি। শুধুমাত্রু রফতানির উপর নির্ভর না করে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখি যে শিল্পগুলো আছে সেগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে স্থানীয় বাজার, স্থানীয় অর্থনীতির কুটির, ক্ষুদ্র শিল্পগুলো কিভাবে টেকশই হবে সেই বিষয়ে দিক নির্দেশনা থাকা জরুরী। সরকারের যে প্রণোদনা প্যাকেজ আছে অন্তত সেটা যথাযথভাবে বিতরণ করতে হবে। কারণ বিতরণ ছয় মাস পরে করলে কোন লাভ হবে না।
সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক না করে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত ও অনুন্নত অঞ্চলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন উৎসাহিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করছি।
সম্ভাবনাময় শিল্প, যেমন কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প, হালকা প্রকৌশল, ব্লু- ইকনোমিসহ আরও অনেক। এই সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর উন্নয়নে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর দরকার হবে। আর এক্ষেত্রে শিক্ষার এটা বড় ভূমিকা আছে। যার মাধ্যমে পেশাদার ও কারিগরি মানুষের উন্নয়ন করা যাবে। এর জন্য মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় এখন অবশ্য প্রয়োজনীয়।
আরও বলেন, প্রবৃদ্ধি গত একদশকে উৎসাহব্যাঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপে ছিল বাংলাদেশ। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণেও সেই চাপ প্রবলতর হচ্ছে। আবার বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির সংক্রমণের কারণে বিশাল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিকের চাকরি অনিশ্চয়তার মুখে। তাই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে প্রবাসী শ্রমিক এবং বেকার তরুণদের জন্য নতুন উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তাদের ঋণ দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অন্যান্য বছরের মতো সুযোগ সন্ধানীরাই এ ঋণ পেয়ে যাবে।
এসএমই উদ্যোক্তাদের ইউটিলিটি সেবাগুলোর ওপর ভ্যাট মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকা কিছুটা সহজ হবে। পাশাপাশি বিসিক এবং ইপিজেডে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভাড়াও মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করার আহ্বান করছি। স্থানীয় পর্যায়ে লোকাল এলসির মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে উৎসে কর ২ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ পূর্বে কোনো উৎসে কর ছিল না। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। আমরা সেটি ২ শতাংশ না করে ১ শতাংশ হারে নির্ধারণের আহ্বান জানাচ্ছি।
রপ্তানিমূখি শিল্পের রপ্তানি মূল্যের উপর উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। বিসিআই সকল রপ্তানিমূখি শিল্পের জন্য উক্ত কর দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারন এবং করপোরেট কর ১০ শতাংশ নির্ধারনের প্রস্তাব করছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ও বৃহৎ শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সহায়তা প্যাকেজ সহ সরকরার ঘোষিত সকল প্রনোদনা প্যাকেজ বাণিজ্যিক ব্যাংকসমুহের মাধ্যমে দ্রুততার সাথে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আহবান জানান। যার ফলে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রথা অব্যাহত রয়েছে যা মোটেই যুক্তি সঙ্গত নয়। কারণ, কালো টাকা উপার্জন এবং এর ব্যবহার উভয়ই অন্যায় এবং অবৈধ কাজ। এতে করে বৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। পরিশেষে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য বিসিআইয়ের পক্ষ হতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এমএজেড/ডি