“লালনের আখড়া এখন মাজার হয়ে গেছে”
ঢাকা: কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়া বাড়ির মূল বৈশিষ্ট্যই নষ্ট হয়ে গেছে, হারিয়েছে নিজস্ব ভাবগত চরিত্রটি। ঝকঝকে আধুনিক ভবনের নিচে চাপা পড়ে গেছে বাউল, ফকিরদের দীনভাবসম্পন্ন সাধনার আদি পরিবেশ।
জাতিসংঘের সুপারিশে ঐতিহাসিক স্থান ও পুরাকীর্তির চার কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণের নিষেধাজ্ঞাও মানা হয়নি। ফলে হারিয়ে গেছে প্রকৃত ফকিরি ভাব। বেহাত হয়ে গেছে আখড়ার ওপর বাউল-ফকিরদের কর্তৃত্ব ও অধিকার। লালনের আখড়ার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে নিজভূমে পরবাসীর মতোই মনোকষ্টে আছেন লালন আখড়ায় উপেক্ষিত অবাঞ্ছিত বাউল-ফকির-সাধকেরা।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আখড়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব ফিরে পায়নি বাউলরা। আইনের দীর্ঘ লড়াই শেষে বাউল ফকিররাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেও বারবারই হার মানছেন বাউলরা।
আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি। একাডেমিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লালনের আখড়া থেকে বাউল-ফকির-সাধুদের বিতাড়ন শুরু হয়।
১৯৮৪ সালের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি লালনের আখড়ায় ধর্মসভার ডাক দিলে মানবধর্মে বিশ্বাসী বাউলেরা এ সভার বিরোধিতা করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বাউল-ফকির বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তাদের আখড়া থেকে বের করে দেয়া হয়।
আখড়ায় নিজেদের নায্য অধিকার ফিরে পেতে ১৯৮৫ সালের পয়লা জানুয়ারি আইনের আশ্রয় নেন বাউল-ফকিররা। দীর্ঘ ১৯ বছরের আইনি লড়াই শেষে ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে লালনের আখড়া পরিচালনার দায়িত্ব বাউলদের সংগঠন ‘লালন মাজার শরীফ ও সেবা সদন কমিটি’র কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ১০ বছর পার হয়ে গেলেও আখড়া ফিরে পায়নি বাউলরা। এই হস্তান্তরের ব্যাপারে সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। লালন একাডেমিও যথারীতি আখড়ার দখল ছাড়েনি।
নিজেদের অধিকার আদায়ে বাউল-ফকিরদের আইনি লড়াই চলাকালীন ১৯৯৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে লালন কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জাতিসংঘের সুপারিশে ঐতিহাসিক স্থান ও পুরাকীর্তির চার কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা না মেনে লালনের আখড়ার মূল চত্বরেই একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন, জাদুঘর ও অতিথিশালাসহ চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। লালনের স্মৃতি নিয়ে বইতে থাকা কালীগঙ্গা নদীটিও ভরাট করে বানানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ।
লালনের আখড়া বাড়িসহ আশপাশের সব জায়গার মালিকানা এখন লালন একাডেমির। অথচ ওই সম্পত্তির সবটুকুই ছিল লালনের নিজস্ব মালিকানায়। ১৮৯০ সালে লালনের মৃত্যুর পর থেকে বাউলরাই ভূমি কর পরিশোধ করে আসছিল। এখন বাউল-ফকিরদের প্রাণের দাবি একটাই-তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক লালন সাঁইজির আখড়া বাড়িটি।
লালন একাডেমি প্রাঙ্গনে বাউল-ফকিরদের অসুবিধা ও সমস্যা বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন বাউল-ফকিরের সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ ফকির বজলু শাহ নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “লালন মাজারের মধ্যে অসুবিধাগুলো হচ্ছে, যেসব ফকিরেরা এখানে ছিল তারা তত্ত্ব-বয়াত করত, সেই আসল ফকিরগোষ্ঠী নাই। এখানে আছে, ধরেন যারা কমিটি বা একাডেমিগোষ্ঠী, তারাই তত্ত্বাবধান করছে। কিন্তু তারা তো ফকিরির যে আইন-কানুন-তরিকা আছে তা জানে না।”
ফকিরি আইন ফকিরেরাই জানে উল্লেখ করে বজলু শাহ বলেন, “ফকিরেরা আগে যে আসন-মান্য-সেবা বা ভক্তিটা করত, ফকির-বাউলদের যে শান্তি, সেই জিনিসটা এখানে আর নাই। অন্য জিনিস হয়ে গেছে। ফকিরের পরিবেশটা-যেটা আমাদের এই তরিকান মতে সেবা, তরিকান মতে ধ্বনি, আসন; তরিকান লোকজন রান্না করবে, চলাফেরা করবে-সেই জিনিসগুলা, সেই পরিবেশটা এখন লালন একাডেমিতে নাই।”
বাউল রাজ্জাক বললেন, “আগে লালনের আখড়া সত্যিকারের সাধুদের আশ্রমের মতো ছিল। এখন তো বিল্ডিং-টিল্ডিং হয়ে অন্য রকম হয়ে গেছে, লালনের আখড়া এখন লালনের মাজার হয়ে গেছে। বাউলদের পরিবেশের আদি যে বৈশিষ্ট্য, সেটা আর নাই।”
তিনি আরো বলেন, “লালন সাঁইজির দুটা স্মরণ উৎসব হয়-একটা হয় তার তিরোধান দিবসে আর একটা দোল পূর্ণিমাতে। সেখানে সাধুসঙ্গ যে নিয়মে হওয়া দরকার সেই রকম হয় না। সেটা আগে হতো।”
তার সাথে একমত পোষণ করলেন সুখ চাঁদ ফকির। তিনি বললেন, “লালনের আখড়া আগে ছিল এক ভাবের। এখন বর্তমানে লালনকে মাথায় তুলে নিচে নামাচ্ছে! কেউ কেউ লালনের নাম ধরে এ দুনিয়ায় ইটের পর ইট গাদি (স্তুপ) করছে। এর কারণ তার প্রেমের প্রেমিক তো নাই। তার যে প্রেম, আসল প্রেমের যে ব্যাথা, এখানে সেটা নাই। এখানে কামড়াকামড়ি হচ্ছে স্বার্থ-অনুগত। লালনের শিক্ষা এটা না।”
তিনি আরো বলেন, “আগে বাউল-ফকিরদের ইচ্ছার যে স্বাধীনতা ছিল এখন তা নাই। যে শান্তি ছিল তা বিক্রি হয়ে গেছে। সেই প্রেমের দেশ আর নাই। লালনের তো ক্ষমতার দম্ভ ছিল না, হাম পারেঙ্গা তাম পারেঙ্গা ছিল না। এখন এসব তৈরি হয়েছে এখানে, এই মাজারে।”
ফকির আব্দুল মান্নান বলেন, “এক শ্রেণীর মস্তান বের হইছে যারা লালন ফকিরকে নিয়ে আজকাল কাড়াকাড়ি-মারামারি করছে, এটা যেন তারা না করে। লালনকে দিয়ে তারা নিজেকে প্রসিদ্ধ করতে চায়, অর্থ উপার্জন করতে চায়। অথচ তারা লালন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারাই আজ লালন আখড়াকে পেশীশক্তি দিয়ে দখল করতে, আচ্ছাদন দিয়ে দিতে চায়।` তিনি বলেন, `লালন ছিল নিজেই এসবের প্রতিবাদকারী। আমিও এর প্রতিবাদ জানাই। আমরা আমাদের লালন আখড়াকে ফিরে পেতে চাই।”
লালন আখড়া রক্ষায় আন্দোলন হয়েছিল। লালন আখড়া রক্ষা কমিটির ব্যানারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আহ্বায়ক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “বাউলরা ভবন বা দালান-কোঠা চায় না। কিন্তু লালন আখড়া বাড়িতে তা-ই করা হয়েছে। কাজটা ঠিক হয়নি। এটা বাউলদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর বাণিজ্যিক আগ্রাসন। এখন এখানে বারোয়ারি মেলা হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছিলাম কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তা চালিয়ে নিতে পারিনি।”
তিনি বলেন, “এখানকার বাউলরা লালনের উত্তরাধিকার। লালন আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাউলদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করে রক্ষা করা দরকার। লালন আখড়া বাড়ির ওপর অধিকার বাউলদেরই। এটা তাদেরকেই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।”
লালন আখড়া রক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন ভাস্কর রাসা। তিনি বাউলদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যুগান্তকারী রায় হিসেবে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “১০ বছরেও এ রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমি বিস্মিত। এ সরকার যেহেতু বলে যে, তারা ঐতিহ্যকে লালন করে তাই এ রায় বাস্তবায়ন করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এ রায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে জাতীয় ঐতিহ্যের ক্ষতি হবে।”
তিনি বলেন, “লালনের ঐতিহ্যের ধারা স্বতঃফূর্ত। একে একাডেমিক নিয়ম-নীতি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। লালনের আখড়া বাড়িটি অবিলম্বে বাউলদের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া দরকার।”
লালন সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, “এ রায় কেন এতদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি তা খুঁজে দেখা উচিত। একাডেমিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক মাস্তানরা লালনের আখড়াবাড়িটি কুক্ষিগত করে রেখেছে। উন্মুক্ত মঞ্চে হাফপ্যান্ট পরা ছেলেমেয়েদের দিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে লালনের গান গাওয়ানো হচ্ছে। এটা তো বাউল-ফকিরদেরই জায়গা, ফকিরদেরই এখানে থাকা উচিত। তাদের হাতেই লালনের আখড়াবাড়িটি ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, “আমি সব সময় বলি লালনের ধাম বাউল-ফকিরদেরই ধাম। অদিক্ষিত জনের এখানে অধিকার নেই। লালনের ধামে বাউল-ফকিরদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়াটা দুঃখজনক ও বিস্ময়করও বটে। যথাশীঘ্র এ ধাম বাউল-ফকিরদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার সাবেক জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়টা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কেউ দেখা করেনি। রায়ের নির্দেশনাটা নিয়ে এলে আমি অনতিবিলম্বে বাউলদের হাতে লালনের আখড়া বাড়িটি বুঝিয়ে দিতাম। আইনের বাইরে তো কেউ নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এ আখড়া বাড়িটির ওপর বাউল-ফকিরদের অধিকার শতভাগ। তাদেরকেই এটা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।”
কুষ্টিয়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই। রায়ের নির্দেশনা নিয়ে আমার কাছে কেউ আসেওনি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করার কোনো সুযোগ বা ক্ষমতা কারো নেই। আমার কাছে রায়ের নির্দেশনা নিয়ে এলে সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিব।”
নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ/এমএম
ফিরোজ এহতেশাম, নিউজবাংলাদেশ.কম