আশা ও শঙ্কা মাথায় নিয়েই পেঁয়াজ চাষে মগ্ন পাবনার চাষিরা
ছবি: নিউজবাংলাদেশ
বুক ভরা আশা আর মনে শংকা নিয়ে পেঁয়াজ চাষে মহাব্যস্ত এখন পাবনার চাষিরা। কন্দ পেঁয়াজ (মুঁড়ি বা মূলকাটা পেঁয়াজ) চাষ করে ক্ষতিগ্রস্থ কিম্বা কম লাভবান হওয়ায় তারা চারা পেঁয়াজ নিয়ে এখন আশা নিরাশার দোলাচলে। তারপরও পেঁয়াজ উৎসব থেমে নেই। তবে গতানুগতিক বীজের বদলে উফশি (উচ্চ ফলনশীল) জাত চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে পেঁয়াজ চাষি ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হবেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত মৌসুমে ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা এবারে হালি বা চারা পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। যদিও কন্দ পেঁয়াজ ( মুঁড়ি বা মূলকাটা পেঁয়াজের দাম খুব কমে যাওয়ায় চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। জ্বালানি তেল, সার ও শ্রমিকের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে গেছে। তারপরও পেঁয়াজ লাগানো চলছে উৎসবের আমেজে। চাষিরা বলছেন, পেঁয়াজ আমদানি না হলে তারা এবারও লাভের মুখ দেখবেন। তবে চাষ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বেশি হবে। এতে দাম কমে যাওয়ার শঙ্কায়ও রয়েছেন চাষিরা।
গত মৌসুমে হালি পেঁয়াজ চাষ করে লাভবান হওয়ায় চাষিরা হালি বা চারা পেঁয়াজ বেশি করেছেন। যারা গতবার পেঁয়াজ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তারাও এবার লাভের আশায় পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। কৃষি শ্রমিকরা সুর্যোদয়ের আগেই মাঠে হাজির হচ্ছেন। সাত সকালেই শ্রমিকদের পদচারণায় মুখর গ্রামের সড়ক কিম্বা মেঠোপথ। সারা দিন কাজ শেষে তারা বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যার আগে। কৃষি শ্রমিকরাও ভালো মজুরি পাচ্ছেন।
কাজের ফাঁকে খেতের পাশে মাটিতে বসেই চাষিরা সেরে নিচ্ছেন দুপুরের খাবার। ছবি: নিউজবাংলাদেশ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে পাবনায় পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৮০১ হেক্টর। এর মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫৮০ হেক্টর। পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ২২ হাজার ৫৯৬ টন। গত মৌসুমে জেলায় ৫৩ হাজার ২ শ ৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাত লাখ ৬০ হাজার মে.টন।
২০২৩ সালে জেলায় ৪৪ হাজার ৮শ ১০ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ লাখ ৯০ হাজার ৪শ ৪৫ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে পাবনা জেলায় ৫৩ হাজার তিনশ পাঁচ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাত লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ মে. টন। ২০২১ সালে (কন্দ ও চারা পেঁয়াজ মিলিয়ে) ৫২ হাজার ৬শ ৪০ হেক্টর জমিতে পিঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯শ ৯৭ মেট্রিক টন। ২০২০ সালে পাবনা জেলায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫-২৬ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মে. টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আর পাবনা জেলার সাঁথিয়া- সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। সে হিসেবে সারা দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুটি উপজেলা থেকে।
তারা জানান, জেলার চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পিঁয়াজের আবাদ করে থাকেন। এর একটি কন্দ( মূলকাটা বা মুড়ি) ও অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মূলকাটা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ ডিসেম্বর মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ হাটে ওঠে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বিল গ্যারকাপাড়, বিল গাজনা পাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি, ইসলামপুর প্রভৃতি মাঠে গিয়ে দেখা যায় এলাহীকাণ্ড। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষ পেঁয়াজের মাঠে। বাড়ির নারীরাও পুরুষ সদস্যদের কাজে সহায়তা করছেন। পেঁয়াজ চাষিরা জানান,সুর্য ওঠার আগেই মাঠে হাজির হওয়া শ্রমিকরা। তারা প্রতিদিন পেঁয়াজ লাগিয়ে সাতশ -আটশ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। পাশের গ্রাম আবার কেউবা দূরের গ্রাম থেকে পেঁয়াজ লাগাতে আসছেন।
চাষের ব্যস্ততা বাড়ায় বড়দের পাশাপাশি কৃষি কাজে অংশ নিচ্ছে পরিবারের ছোটরাও। ছবি: নিউজবাংলাদেশ
দেশের অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়ার বনগ্রাম হাটে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ কন্দ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩ শ- ১৪ শ টাকা দরে। চাষিরা জানান, আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন হালি পেঁয়াজ হাটে উঠতে শুরু করবে। আর সরকারি আমাদনি শুরু করলে তখন আরও দাম কমার আশংকা রয়েছে। আমদানি করলে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন আর লাভবান হবেন মধ্যসত্ত্বভোগীরা।
সাঁথিয়া উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের চাষি আফতাব উদ্দিন, কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আরশেদ খান, কানু খান এর সাথে কথা বলে জানা যায়, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই পেঁয়াজ বীজ কেনা, চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া করতে হয়। জমি চাষ সেচ, সার,গোবর, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তাদের বিঘা প্রতি বাৎসরিক ২০ -২৫ হাজার টাকা লিজমানি জমি মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরো বেশি। এছাড়া অনেক ছোট -বড় চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পাবনার উপ-পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে। গত মৌসুমে ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা এবার উজ্জীবিত। আবহাওয়া ভালো থাকলে ভালো ফলন হবে এবং চাষিরা এবছরও লাভবান হবেন।
নিউজবাংলাদেশ.কম/এনডি