চরা দরেও লোকসান পোষাতে হিমসিম খাচ্ছেন লেবু চাষীরা
বাজারে লেবুর দাম এখন চরা। ক’দিন আগেও হালি প্রতি লেবু বাজারে যেখানে বিক্রি হয়েছে ৮-১০ টাকায়। সেই লেবু এখন স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা হালি। তারপরও কৃষকরা লোকসান গুনছেন দাবি করে বলছেন, গেল বন্যায় পানিতে বাগানের গাছ মরে যাওয়ায় ফলন কম হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসও বলছে, বন্যায় ৫১০ হেক্টর জমির লেবু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে ২০০ হেক্টর জমির লেবু গাছ। তাই চাহিদার তুলনায় লেবুর উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে লেবুর দাম চরা। তাছাড়া লেবুর সিজন না থাকার কারণে ফলনও কম।
বালিয়া ইউনিয়নের লেবু চাষী হুকুম আলী নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “চৌহাট ইউনিয়নের ভাকুলিয়া, যাদবপুর ইউনিয়নের ঝাউতারা আর বালিয়া ইউনিয়নের তেঁতাইল এলাকায় ৯১ বিঘা জমি চাষ করেছি। আমি কারো ১০০ শতক কারো ৫০ শতক জমি পত্তন নিয়েছি। ওই জমিন গুলোতে ওরাই (স্থানীয় কৃষক) বাগান করছে। বছরে ১৫০০-২০০০ টাকা শতক প্রতি কিনে নিয়েছিলাম। বন্যায় অর্ধেক জমির গাছ মরে যাওয়ায় ওগুলোর টাকা-পয়সা
সব মাইর গেছে। কিছু কিছু জমিতে গাছ আছে কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। অর্ধেকের মতো নষ্ট হয়ে গেছে। জমিনে যা গাছ আছে ওগুলোতে ফসল খুবই কম। ফসল নেই বললেই চলে। ১০০ শতাংশ জায়গা থেকে এখন ২০০০-২৫০০ লেবু পাওয়া যাইচ্ছে। আগে ছয় থেকে সাত হাজার লেবু পাওয়া যেত। বন্যার কারণে কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা লস হয়েছে আমার।”
এখন দাম কেমন পাচ্ছেন এ প্রশ্নে হুকুম বলেন, “আমরাতো খাঁচি হিসেবে বেচি। অহন ৫০-৬০ হাজার টাকা খাঁচি এরকম যায়। এক খাঁচিতে ৪০০০-৫০০০ লেবু হয়। সে হিসেবে ১০-১২ টাকা পিস। আর হালি ৪০-৫০ টাকা। লেবু বুঝে দাম। লেবুতো ছোট বড় আছে। কোনোটা ৫০ টাকা, কোনোটা ৩০ টাকা আবার কোনোটা ১০০ টাকাও হালি বিক্রি হয়।”
“আমাগো এহানকার ছোট পাইকাররা ২০০ লেবু নেয় মনে করেন ১৫০০ ট্যাকা দিয়া। ৭-৮ ট্যাকা পিস পড়ে। অরা আবার এক হালি লেবু বেইচা ১০-১৫ ট্যাকা লাভ করে। ঢাকার পাইকাররা এই দামেই কিইন্না ৫০-৬০ ট্যাকা বেচে। বড় লেবু ৮০-১০০ ট্যাকাও বেচে সময়তে।” বলেন তিনি।
আরেক লেবু চাষী সেলিম হোসেন নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “গেল বন্যায় আমার আড়াইশ শতাংশ জমি নষ্ট হয়ে গেছে। একশ শতাংশে খুব বেশি হলে ২০-২৫টা চারা বাইচা আছে। আবার কোনো কোনো জমিতে একটা গাছও নাই। পুরাটাই খালি। সব মিলে ৫০-৬০টা চারা এখন আছে। আর একশ শতাংশ জমিতে লেবু চাষ করতে কম করে হলেও
১ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। একশ শতাংশ জমিতে গাছ লাগবে সাড়ে ৪শ। একশ শতাংশ জমি থেকে সারা বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার লেবু আসবে। তিন মাস অন্তর অন্তর লেবু তোলা হয়। মানে বছরে তিনবার কইরা লেবু তোলা যায়। এখন ফলন একদম কম। তাছাড়া এখন লেবুর সিজন না। আগামীতে সামনে যে বৃষ্টি হবে, মে মাস থেকে লেবুর ফলন বেশি পাওয়া যাবে।”
বর্তমান বাজার দরে লেবু বিক্রি করে তার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব কিনা সে ব্যাপারে তিনি বলেন, “এটা কখনই সম্ভব না। মনে করেন আড়াইশ জমিতে যদি ৫০-৬০টা গাছ থাকে তাহলে ক্ষতিটা কিভাবে পূরণ হবে? দাম যতই বাড়ুক এটা কখনই সম্ভব না।”
তিনি আরো বলেন, “বাগানে নতুন কইরা পুনরায় চারা রোপণ করতাছি। সেখানে পানি দিতাছি, আগাছা পরিষ্কার করতাছি, রাসায়নিক সার কীটনাশক এগুলা ব্যবহার করতাছি। আবার পুনরায় পরিপূর্ণভাবে কিভাবে গাছগুলা সুন্দরভাবে বড় করা যায় সেভাবে চেষ্টা করতাছি আমরা।”
সরকারি সুবিধা পেয়েছেন কিনা এ প্রশ্নে সেলিম বলেন, “উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এ ধরনের কোনো কিছু আমরা সুবিধা পাই নাই। আর এটা নিয়া তারা কোনো গঠনমূলক কথা বলেও নাই। যদিও তারা এসে থাকে হয়তো বা আমি তখন ছিলাম না। কিন্তু আমি দেখি নাই তারা কোনো কৃষকের কাছে গিয়ে মত প্রকাশ করছে।”
ধামরাই উপজেলা কৃষি অফিসার আরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “বন্যার পরবর্তী সময়ে লেবু গাছে ফুল ধরছে কম। বন্যা যাওয়ার পরে গাছগুলো একটা স্ট্রেসের মধ্যে পড়ছে। অনেক গাছ মারা গেছে। যেগুলো আছে সেগুলো কোনোমতে বেঁচে আছে। এ কারণে গত এই দুই-তিন মাসে ফলটা সেভাবে ধরতে পারেনি। বন্যা পরবর্তী কার্যক্রমে আমরা কৃষকদের বলছি পুলিং করে দিতে। কিন্তু যে কিছুই করেন এ সিজনে যে সমস্ত এলাকায়
বন্যায় পানিতে ডুবে গেছিল। ওই সমস্ত এলাকায় লেবুটা কমই হবে। এটা কোনোভাবেই আর সম্ভব না। কোনো কৃষি প্রযুক্তিই আর এখানে কাজে দেবে না।”
তিনি আরো বলেন, “ধামরাইয়ে ৭২০ হেক্টর জমিতে শুধু লেবু বাগান। এখন আসলে মেইনলি লেবুর সিজন না। লেবুটা কিন্তু এখন অফ সিজন। লেবুরতো কিছু সিজন আছে। যদি গাছের অবস্থা ভালো থাকতো তাহলে অফ সিজনেও যে সমস্ত লেবু ধরে সেগুলো দিয়া চাহিদাটা অনেকটা পূরণ হতো। যেহেতেু অনেক লেবু বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। যে গুলো ডুবে গেছে সেই ডাল গুলো মারা গেছে। আবার উপরের ডাল গুলো এখনও বেঁচে আছে। ওই খানে কিছু কিছু ফুল দিয়েছে। আমার মনে হয় আর কিছু দিন পরে সেটা আবার কাভার হয়ে যাবে।”
লেবুর বর্তমান বাজার দরে ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে বলেন, “আসলে লোকাল বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভোক্তা অধিকার দেখবে। কিন্তু কেবল এই জায়গায় যদি কম-বেশি হয় তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আসবে। তখন বোঝা যাবে উৎপাদনের চেয়ে ভোক্তাদের চাহিদা বেশি। উৎপাদন যতটুকু হচ্ছে যোগান ততটুকু দিতে পারছে না।”
নিউজবাংলাদেশ.কম/এফএ