“রাইতে ফিরতে সময় মাঝে মইধ্যে নেশা করইন্যারা (মাদকাসক্ত) ধরে। ট্যাহা (টাকা) নিয়া যায়। কেউ দেখলেও কিছু কয় না”
“রাইতে ফিরতে সময় মাঝে মইধ্যে নেশা করইন্যারা (মাদকাসক্ত) ধরে। ট্যাহা (টাকা) নিয়া যায়। কেউ দেখলেও কিছু কয় না”
সূর্য পূর্ব দিকে উঠে, পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। এটি একটি চিরন্তন সত্য। রাজধানী ঢাকার জন্য ঠিক তেমনই একটি চিরন্তন সত্য হল রাস্তার যানজট। যানজট ছাড়া যেন ঢাকা শহর কল্পনাই করা যায়না।
যানজট প্রতিমুহুর্তেই হচ্ছে কিন্তু জীবন থেমে থাকছেনা। কেউ পেটে দু’মুঠো খাবারের জোগান দিতে, কেউ বাড়তি আয়ের জন্য, কেউবা চাকরির প্রয়োজনে প্রতিদিনই যানজট উপেক্ষা করে পথ পাড়ি দিচ্ছেন। তারা ক্লান্ত হচ্ছেন বটে কিন্তু হাল ছাড়ছেন না, জীবন তো চালাতে হবে।
এই যানজটের ফাঁকেই দেখা মেলে ছোট ছোট বাচ্চাদের। কেউ ফুল বা ফুল দিয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করছে, কেউ পানি আবার কেউবা নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এই যানজটই তাদের ও তাদের পরিবারের আয়ের উৎস।
এরা রাস্তার ধারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ট্রাফিক সিগনাল পড়বে, লালবাতি জ্বলে উঠবে, গাড়ি থামবে আর তাদের হাতে থাকা পণ্য গুলো বিক্রি করে শেষ করবে। যত দ্রুত টাকা হাতে আসবে তত দ্রুত ঘরে চাল ডাল নিয়ে ফিরতে পারবে। হয়তো ঘরে এখনো রান্না হয়নি, ছোট বোনটি না খেয়ে আছে, অসুস্থ মা ছেলের পথ চেয়ে বসে আছে কখন ছেলে খাবার নিয়ে ফিরবে। এসব চিন্তা করতে করতে সিগনাল পড়ে। গাড়ি এসে থামে। তারাও এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়ির দরজায় ছুটে যায় পণ্য বিক্রির আশায়।
এদেরই একজন ইব্রাহীম। বয়স ১৩ বছর। বাবা মোহাম্মদ জুয়েল মারা গেছেন । বাড়ি কামরাঙ্গির চর। বাবা রিকশা চালাতেন। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের সময় মারা যান তিনি । পরিবারে আর আছেন মা আর ছোট বোন জেসমিন।
ইব্রাহীম এলিফ্যান্ট রোডে চুলা থেকে হাড়ি-পাতিল ধরার জন্য ব্যবহৃত কাপড়(লুসনি) বিক্রি করে । কাছে ডেকে এনে পরিচয় পর্ব সারলাম। এখানে কোথায় থাকো জিজ্ঞেস করতেই সে জবাব দিলো “প্রতিদিন যাই আসি।” এই উত্তরের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কথাটা বেশ ভাবালো। পেটের তাগিদে এই বয়সের একটা ছেলে এতদূর যাতায়াত করে! সে একে একে জানালো তাদের দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত হবার গল্প।
পরিবারের সবাই একই কাজে জড়িত। গার্মেন্টস থেকে কাপড় ডজন হিসাবে কিনে এনে লুসনি বানিয়ে রাস্তায় জোড়া হিসেবে বিক্রি করে। তিনজন মিলে যা আয় হয় তা দিয়ে একটা দিন ভালোই কেটে যায়। কিন্তু কোনোদিন যদি কেউ অসুস্থ থাকে বা ঠিকমত বিক্রি না হয় সেদিন না খেয়েও থাকতে হয়।
“রাইতে ফিরতে সময় মাঝে মইধ্যে নেশা করইন্যারা (মাদকাসক্ত) ধরে। ট্যাহা (টাকা) নিয়া যায়। কেউ দেখলেও কিছু কয় না” অনেকটা অভিযোগের সুরেই বলল সে। এই কথার পর তাকে আর কোন প্রশ্ন করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কিছু শুকনা খাবার কিনে দিয়ে তাকে বিদায় দিলাম। সে ছুটে গেলো রাস্তার পাশে। আবার শুরু হল তার অপেক্ষার পালা।
আমি বাড়ির পথে হাটতে শুরু করলাম আর ভাবতে লাগলাম যে বয়সে স্কুলে, খেলার মাঠে দৌড়ানোর কথা সেই বয়সে পরিবারে অর্থ জোগানোর চাপ, আবার সেই আয় কেড়ে নেওয়া! কোথায় আছি আমরা, এর ভবিষ্যৎ কোথায়?